রমা ঘুম থেকে উঠেই দেখল পায়ের গোড়ালিটা টনটন করছে। এখন মাটিতে পা রাখলেই মনে হবে যেন কাঁকড়া কামড়ে ধরল পায়ে।
রমা শুয়ে শুয়েই জপের মালাটা বালিশের নীচ থেকে বার করল। জপ শুরু করল। মন এই সময়টা ছুটি পায়। বেড়াতে যায়। আজকাল বড় ছোটোবেলার কথা মনে পড়ে রমার। বয়েস হচ্ছে বলে কি? ওপার বাংলার কথা মনে পড়ে।
রমা কল্যাণী থেকে শিয়ালদা ভিক্ষা করে ট্রেনে। প্রায় কুড়ি বাইশ বছর হল। সাড়ে এগারোটার বজবজ লোকাল দিয়ে শুরু করে। বারাকপুর নামে। আবার কল্যাণীর দিকে আসে। এইভাবে যাতায়াত করতে করতে রাত হয়ে যায়। পা টাটায়। মন শরীর ক্লান্ত হয়। হালিশহরে নামে। হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির দিকে যায়। বাড়ির সামনে এসে কলের জলে পা ধোয়। তালা খোলে। বাথরুমে যায়। গায়ে জল দেয়। বাইরে আসে। কাপড় ছাড়ে। ভাত বসায়। কোনোদিন রুটি কিনে আনে। কোনোদিন দুটো শুকনো মুড়ি, লঙ্কা দিয়ে।
রমা উঠল। পা’টা মাটিতে রাখতেই বলে উঠল, উফ মা গো!
======
রমা দরজায় তালা লাগিয়ে ফিরে দাঁড়াতেই থমকে দাঁড়ালো। জবা গাছে লাল টকটকে পাঁচটা জবা ফুটে।
রমার চোখদুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠল। এখন স্টেশানে গিয়ে চা আর একটা কেক খায়। কিন্তু আজ ইচ্ছা করল না। আজ এমনিতেই তাড়াতাড়ি বেরিয়েছে আগের ট্রেনটা থেকে কাজ শুরু করবে বলে, আজ তো রবিবার। ফাঁকা ট্রেন। সাড়ে ন'টার কল্যাণীটা দিয়েই কাজ শুরু করবে।
রমা জবাগুলো তুলল। স্টেশানের উল্টোদিকে হাঁটতে শুরু করল। পা টাটাচ্ছে। খিদেটাও জ্বালাচ্ছে। তবু উল্টোদিকে হাঁটছে। হাঁটতে হাঁটতে রামপ্রসাদের ভিটের সামনে এসে দাঁড়ালো। কত ভিখারি বসে। রমা সবাইকে চেনে। ওরাও চেনে। কিন্তু এখন দাঁড়ালে হবে না। সংসারে কি বেশি মেয়েমানুষ ভিখারি?
ভিটেতে ঢুকল। মা দাঁড়িয়ে। শিব শুয়ে। রমা মায়ের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। গ্রিলের বাইরে। পাঁচটা জবা বার করল হাতের প্লাস্টিকটা থেকে। পুরোহিতের হাতে দিয়ে বলল, মাকে দিয়ে দাও তো।
পুরোহিত হাতে নিয়ে বলল, প্রসাদ নিয়ে যাও।
একটা সন্দেশ হাতে দিলো রমার। রমা প্রণাম করে মুখে পুরে বলল, আসি বুঝলে।
পুরোহিত বলল, একটু বসবে না?
রমা বলল, না গো… রবিবার আজ, বেশিক্ষণ কাজ।
পুরোহিত বলল, দুপুরে প্রসাদ খেয়ে যেতে….
রমা হাসল। বলল, অন্য কোনোদিন।
জবাগুলো মায়ের পায়ের কাছে রাখা। মা দাঁড়িয়ে আছে। রমা মনে মনে বলল, ভালো থেকো মা…. দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গোড়ালি টাটায় না?
রমার মা ওপার বাংলায় মরেছিল। এপারে আসেনি। রমাকে পাঠিয়ে দিয়েছিল বড়মাসির সঙ্গে, সেই কোন ছোটোবেলায়। কেউ বলে তার মাকে ধর্ষণ করেছিল মারার আগে। কেউ বলে গলায় দড়ি দিয়েছিল। কেউ বলে পুকুরে ডুবেছিল। রমা ভিটেতে এসে মায়ের দিকে তাকায়। বুকটায় শান্তির জল নামে। আর কিছু চাইতে ইচ্ছে করে না। যেন কোনো অভাব নেই। কোনোদিন ছিল না। বেঁচে তো আছে। এই বা কম কি!
বাইরে ভিখারিরা জিজ্ঞাসা করল, কেমন আছ?
রমা বলল, ভালো।
গোড়ালিটা টাটাচ্ছে। ভীষণ টাটাচ্ছে। আসলে বুকের ভিতরটা মুচড়াচ্ছে। খুব জোর মুচড়াচ্ছে। দুপুরে কোনোদিন প্রসাদ খেতে আসেনি। আসবেও না। কষ্ট হবে ভীষণ। মায়ের সামনে খাওয়া যায় না। খেতেও চায় না। মা জানুক মেয়ের অনেক আছে। সে দিতেই আসে। চাইতে নয়।