শরীরটা গ্রাম গ্রাম, তার মধ্যে কব্জা করতে চাইছে শহুরে আত্মা। কলকাতা থেকে বেশ কিছুটা দূরের একটা গ্রাম। এতটা দূরেরও নয় যে কলকাতা বিদেশ, আবার এতটা কাছেও নয় যে কলকাতার শ্বাস-প্রশ্বাসের আঁচ লাগে। আঁচটা না লাগলেও তাপটা লাগে।
নিভাননী যখন গঙ্গার জলের ঘটিটা বাঁ হাতে নিয়ে ডান হাতে ধুপের কাঠিদুটো ধরে রাস্তায় এসে দাঁড়ালেন তখন পুরোপুরি সন্ধ্যে। উঠানের রাস্তা লাগোয়া বড় গাছটায় পাখিদের ঘরে ফেরার পরের কিচিরমিচির। নিভাননী দরজার মুখটায় গঙ্গাজল ছিটালেন লম্বা করে, প্রথমে বাঁ দিক থেকে ডান দিকে, তারপর আবার ডান দিক থেকে বাঁ দিকে, মুখে বললেন, হরি... হরি... হরি...। তারপর ধুপ দেখালেন। পিঠটা কুঁজো হয়ে এই কাজটা রোজ করতে হয়। একবার নীচু হলে সোজা হতে বেশ কষ্ট হয়। ধীরে ধীরে দরজার বাঁশটা ধরে দাঁড়ালেন। রাস্তার পাশের স্ট্রিট লাইটটা জ্বলে গেছে। সাদা লাইট, তার থানের মত।
নিভাননীর বয়েস প্রায় আশি ছুঁই ছুঁই। কত্তার মুখটাও ভাল করে মনে পড়ে না মাঝে মাঝে। ছবিটার বাঁ দিকটা আরশোলা চেটে দিয়েছে, না খেয়ে নিয়েছে ভগবানই জানেন।
পরেশের ছেলেটা চীৎকার করছে, কি একটা মোবাইল কিনে দিতে হবে। পরেশ ভ্যান চালায়, ওর মা লোকের বাড়ি বাসন মাজে। ছেলেটা স্কুলে পড়ে, ছোঁড়ার বয়েস এই সতেরো কি আঠারো হবে। কি তেজ দেখো! বলে এখনই ব্যাঙ্ক থেকে না কিসের থেকে দশ হাজার টাকা তুলে দিতে হবে। কি আশ্চর্য জেদ, কি একটা যন্ত্র আছে যেখান থেকে কার্ড ঢোকালে টাকা বেরোয়, স্টেশানের পাশে দেখেছে নিভাননী। বারের পূজো দিতে যায় তো প্রত্যেক সপ্তাহে। হারুর মা একবার তাকে ঢুকিয়েছিল ওই কাঁচের ঘরটায়, কি ঠাণ্ডা, জৈষ্ঠের তাপ একেবারে মাঘের মত করে দিয়েছে ভিতরটায়। কি সব আশ্চর্য! আর এতেই তো মানুষের এত রোগ আজকাল। আরে সব যদি যন্তর করে দেবে তো ভগবান গতরটা দিয়েছিল কি কত্তে! মাথা গরম হয়ে যায় নিভাননীর, আজকালকার মেয়েদের ছেলে বিয়োতেও কষ্ট। পেট চিরে বার করবে, যত অনাসৃষ্টি! কেন তার সন্তু কোথায় হয়েছিল? এই বাড়িতেই তো। রমেনের মা দাই ছিল। মরেছে সে মাগী।
সন্তু। তার একমাত্র ছেলে। আমেদাবাদে থাকে। সেখানেই চাকরী। নিভাননী যেতে চায় না, হাজার হোক শ্বশুরের ভিটে। প্রাণ যায় তো এই ভিটের থেকেই যাক।
পরেশ তার প্রতিবেশী। ছেলেটা এখনও চীৎকার করছে। কি বাঁদর রে বাবা! একটা ঠাঁটিয়ে গালে দিতে পারছে না। আর দেবেই বা কি করে? এত বয়সে ছেলে হলে অমন আদিখ্যেতা হয় একটু। কম তো দেখল না। পরে বুঝবে। নিভাননীর পা-টা টাটাচ্ছে, আর দাঁড়াবে না। ধীরে ধীরে ঘরের ভিতর এসে খাটে বসল। দুটো ঘর। একটায় সে শোয়, আরেকটাকে ঠাকুরঘর করে রেখেছে। যদিও দুটো ঘরের মাপ একই। সন্তু ঘর বড়ো করে দেবে বলেছিল। নিভাননীই দেয়নি। কি হবে করে? সন্তুর একটা মেয়ে। তার বিয়ে হলে কে থাকবে এখানে? বৌমা কলকাতার মেয়ে, সে তো এখানে একবেলাই টিকতে পারে না। বড় ভালো মেয়ে। খুব ভালোবাসে নিভাননীকে সে। তার গায়ের রঙটা একটু চাপা। নিভাননীর বেশ উজ্বল গায়ের রঙ। বৌমা প্রায়ই বলে, ইস্ মা, আপনার মত যদি গায়ের রঙটা পেতাম। নিভাননী হাসে।
খাট থেকে উঠে ঠাকুরঘরে এসে বসল। সিংহাসনটা তার শাশুড়ির কেনা। গোপাল আছে। পাশে গৌরাঙ্গ আর নিতাই। একটা লক্ষীর ঘট সামনে।
আসব ঠাকুমা?
কাবেরী। এখানকার পোস্ট মাষ্টারের মেয়ে। বিধবা। নিঃসন্তান। বরটা গলায় দড়ি দিয়ে মরেছিল। পাশের গ্রামেই থাকত। নিভাননী পিছন দিকে না ফিরেই বলল, আয়।
কাবেরী গিয়ে নিভাননীর পাশে বসল। বলল, চা করব?
দাঁড়া, আগে সন্ধ্যেটা দিয়ে নিই। তারপর বসাস। আজ একটু পা-টা মালিশ করিস তো, বড্ড টাটাচ্ছে বিকাল থেকে।
কাবেরী বলল, তা হবে না? আজ অমাবস্যা তো, আমারই হাঁটুটা কনকন করছে সেই বেলা দুপুর থেকে।
নিভাননী চোখ বন্ধ করে জপে বসল। কাবেরী সামনের দেওয়ালে ডুমটার পাশে একটা টিকটিকির দিকে তাকালো। সামনে একটা পোকা, পা টিপে টিপে টিকিটিকিটা এগোচ্ছে। পোকাটা বুঝছেও না, কি নিয়তি সত্যি। উড়িয়ে দেবে? না থাক, ঠাকুমার জপ ভুল হয়ে যাবে।
খেয়ে নিল। কাবেরীর মুখ থেকে 'ইস্...' বেরিয়ে এলো। ঠাকুমা শোনেনি। কানে কম শোনে, জোরে কথা বলতে হয়। এই বুড়িটাকে খুব ভালোবাসে কাবেরী। তার বাপ-মা দুই-ই মরেছে। তার আশ্রয় বলতে এই বুড়ি, আর কাজ বলতে পোস্ট অফিসে এটা সেটা করে দেওয়া। তার বাপের জন্যেই লোকে করে। তার বাপ এ অঞ্চলের খুব নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ ছিল। কি যে কুষ্ঠী মেলালো! একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল তার। টিকটিকিটা আবার ডুমের আড়ালে চলে গেছে। ভুতোর বড়দা, গমকলের নিতাই, পরেশের শালা - এরকম কিছু মুখ মনে পড়ল। ওরাও অপেক্ষা করে। তাকে অবশ্য ইচ্ছা করেই নষ্ট হতে হয়েছে কয়েকবার, নয় তো বাঁচতে দিত না। ঠাকুমা জানে। ঠাকুমা বলে, ওতে দোষ নেই, তুই তো আর ইচ্ছা করে ওতে পা দিসনি। একটা পুরুষের কাছে বিকানো বরং ভালো, না হলে শেয়াল কুকুরের মত ছিঁড়ে খাবে সব।
বলাইয়ের অবশ্য সংসার আছে। এখানকার রেশনের দোকানটা তো ওদের। তার বড় বড় দুই ছেলে। কলেজে পড়ে। বৌদি সুন্দরী। তবু পুরুষের ইন্দ্রিয়! ঠাকুমা বলেন, পুরুষের কামনা কাশীর শ্মশানের মত, ও আগুন নেভে না।
নিভাননীর আঙুল একটার পর একটা করে ঘুরছে। মাথার মধ্যে নাম। বুকের মধ্যে একবার পরেশের মুখ, ওর ছেলের মুখ, সন্তু-বৌমা-নাতনির মুখ... এখন কাবেরীর মুখ। মেয়েটার শাড়ির গন্ধটা পাচ্ছে নিভাননী। একটা সেন্ট মেখেছে। বলাই দিয়েছে হয়ত। নিভাননী ঈশ্বরের সাথে একটা বোঝাপড়া করে নিয়েছে। একটা পাওনা-গণ্ডার হিসাব। সে বলে, দেখো বাবা, মানুষের একটা শরীর আছে আর মন আছে। মনের গতি বর্ষার মেঘের মত। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গণৎকারও মানুষের ভাগ্য হয়ত গুণে বলে দিতে পারে সে কবে কোন খাতে বইবে, কিন্তু মনের খবর কে বলবে? ঠাকুর তুমিই কি বোঝো? কাবেরী সমাজের চোখে নষ্ট। হোক। তার জন্য দায়ী কে ঠাকুর, তুমি নও? তুমি আমাদের দোষ খুঁজে বেড়িও না, আমিও বেড়াব না। বিচারে তোমার দিকও কম ভার হবে না ঠাকুর!
নিভাননী গোপালের দিকে তাকালো, আড়চোখে দেখল, কাবেরী উপরে দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে কি একটা দেখছে। নিভাননী আবার গোপালের দিকে তাকালো, তুমি পাপ-পূণ্যের হিসাব রাখো ঠাকুর? রেখো না। ছেড়ে দাও। ঘড়ার জল গঙ্গায় মিশলে কি আর গঙ্গার জাত যায় গোবিন্দ? এদের মুক্তি দাও। গঙ্গা না পাক, অন্তত একটা দীঘির ব্যবস্থা কোরো এ অভাগীটার জন্য। বলাইয়ের ভালোবাসাটাই যেন পায় আজীবন। ভালোবাসায় পাপ কি গো? পাপ তো ভালোবাসার আগে শরীর জাগলে। এ মুখপুড়ির তো...
নিভাননীর তার বরের মুখটা মনে পড়ল। তার বরের মুখটা গোপালের মুখের সাথে মিশে গেল। স্বামীও কি সন্তান হয়? “হয় নিভা হয় (নিভাননীর মা নিভাননীকে নিভা বলে ডাকতেন), অবশেষে সব পুরুষই মেয়েদের স্তন যোনি ছাপিয়ে একটা মায়ের মত বুক খুঁজবে। বলাইও খুঁজবে কাবেরী... তুই সেই স্নেহটা বুকে জমিয়ে রাখিস, শেষে ওটাই কাজে লাগে।”
নিভাননী চোখ খুলল, কাবেরী একটা কথা রাখবি মা?
কাবেরী অন্যমনস্ক হয়ে বলাইয়ে ডুবেছিল। সে একটু চমকে বলল, কি ঠাকুমা?
আমি চলে গেলে তুই আমার এ গোপালের ভার নিবি?
নিভাননীর গলা বুজে এলো। কাবেরী ঘাবড়ে গিয়ে বলল, তুমি তো সব জানো ঠাকুমা... আমি তোমার মত শুদ্ধ তো নই...
চুপ! চুপ কর কাবেরী, গোপালের সামনে ওসব বলিসনি, তিনি নিজেই বলেছেন তোর হাতের সেবা তার চাই...
কাবেরী নিভাননীর কোলে মুখ গুঁজে কেঁদে ফেলল, নিভাননী তার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল, মা হতে শেখ মা, সে এলো বলে...
নিভাননীর চোখে ভাসছে তার স্বামীর মুখ, বলাইয়ের মুখ... সব গোপাল।