ঘরের একটা কোণে গুড নাইট জ্বলছে। খাস্তগির একটা পুরোনো খবরের কাগজ কেটে নৌকা বানাচ্ছে। সামনের বড় পুকুরে ছাড়বে। তাতে কয়েকটা পিঁপড়ে তুলে দিয়ে যাত্রীও বানাবে। খাস্তগিরের বয়েস ছত্রিশ।
খাস্তগির একলা মানুষ। মা মরেছে। বাপ মরেছে। ভাই-বোন আত্মীয়স্বজন নেই কেউ। খাস্তগির বেলা হলে বেল গাছে চড়ে। দুপুর বাড়লে কালী মন্দিরে গিয়ে দু মুঠো খায়। খেয়ে মন্দির চাতালে ঘুমায়। বিকেল হলে পুকুরপাড়ে মাছ ধরে। সন্ধ্যেবেলা তারকের মুদির দোকানে বসে থাকে। রাত বাড়লে খগেন তান্ত্রিকের বাড়ি আফিং খেতে যায়। রাত্রে বাড়ি ফিরে এসেই গুড নাইট জ্বালায়। এইটাই একটা শখ। সে বাড়ি থাকলেই ওটা জ্বলে। তাতে তেল ফুরিয়েছে কত বছর হল। তবু জ্বালায়।
খাস্তগির বেলগাছে বসে। এইখান থেকেই সে গুড নাইটের গন্ধ পাচ্ছে। কোনো শত্রু আসতে পারছে না তার কাছে। খাস্তগির আরো উপরের দিকে চড়ে বসল। নীচ দিয়ে কুকুর যাচ্ছে। কালো গা। ঘা হয়েছে। কুকুরটার গায়ে একটা পাতা টিপ করল। পাতাটা উড়ে গিয়ে মাটিতে পড়ল রাস্তার উপর। সাইকেলের চাকায় গেল মাড়িয়ে। সাইকেল চালায় কে? বৈকুণ্ঠ? দুধ বেচে।
খাস্তগিরের নৌকাটা মাঝ পুকুরে। কাকে ঠোকরায়। পানকৌড়িতে ঠোকরায়। মাছে গুঁতো দেয়। নৌকাটা তবু ভাসে। পিঁপড়েগুলোকে দেখতে পাচ্ছে খাস্তগির গাছে বসেই। পিঁপড়েগুলো কান্নাকাটি করছে। ভাবছে নৌকাটা বুঝি ডুবল এবার। খাস্তগিরের হারু মিস্তিরির কথা মনে পড়ল। তার লাটাই কেড়ে নিত। ঘুড়ি কেড়ে নিত। অসভ্য! মরে গেছে। খাস্তগির চীৎকার করল, আঁ....আঁ...আঁ...
কয়েকটা কাক, বক উড়ে গেল। নীচে কুকুরটা বসতে যাচ্ছিল, লেজ তুলে দৌড়ে পালালো। খাস্তগির কাঁদছে। লাটাইয়ের জন্য কাঁদছে। মায়ের জন্য কাঁদছে। সুজনের জন্য কাঁদছে। সুজন খাস্তগিরের বন্ধু ছিল। সাপে কেটে মরেছে সেই ছোটবেলায়। খাস্তগিরের চোখের জল বেল ডালে পড়ছে। চুঁইয়ে চুঁইয়ে মাটিতে পড়ছে। একটা কেন্নো গাছ বেয়ে উপরে উঠছিল। খাস্তগিরের চোখের জলে বাধা পেয়ে থমকে দাঁড়ালো। খাস্তগির নীচু হয়ে ঝুঁকে ওকে একটা আঙুলে তুলে অন্য ডালে বসিয়ে দিল।
খাস্তগির এম এ পাশ। তখন তার মাথার ব্যামো কই? হঠাৎ করে মাথার মধ্যে সুতো ছিঁড়ল। চিন্তাগুলো ঝড় আসা বনের মত অস্থির হয়ে রইল সেই থেকে। চিন্তাগুলো থামে শুধু গুড নাইট জ্বাললে। খাস্তগির গাছ থেকে নামল। পুকুরে নামবে। সাঁতার কাটবে কয়েক ঘন্টা। মাঝে মাঝেই কাটে। যেদিন পূর্ণিমা সেদিন সারারাত কাটে। পুকুরটার ডানদিকের জলে চাঁদ ওঠে। সারারাত ভাসতে ভাসতে, সাঁতার কাটতে কাটতে চাঁদটা বাঁ দিকের পাড়ে উঠে মিলিয়ে যায়। কোথায় যায়? জুঁইয়ের বাড়ি?
জুঁই। খাস্তগিরের প্রথম প্রেম। শেষ প্রেম। ব্যর্থ প্রেম। তাদের বাড়ির পিছনের পাড়ায় বাড়ি। বিয়ে হয়ে গেছে। তার বরের মুদির দোকান। সে দোকানে মেলা গুড নাইট রাখা। জুঁই তাই ভালো আছে। ভালো থাকবেও। খাস্তগিরের দুঃখ হয় না। আবার হয়ও। খুব বৃষ্টি পড়লে। ঝড় হলে কারেন্ট চলে যায়। গুড নাইট জ্বলে না। খাস্তগিরের ভয় করে। ভীষণ ভয় করে। মা আসে না। সে তো মরে গেছে। জুঁই কি করে? আসতে পারে না? কি করে আসবে, ওর বাড়িতে তো ইনভার্টার। ওর বাড়িতে তো গুড নাইট জ্বলতেই থাকে।
খাস্তগির সাঁতার কাটছে। বেলা বাড়ল। হঠাৎ কালো করে এলো আকাশ। তুমুল ঝড় উঠল। পুকুরের মধ্যেই ঢেউ উঠল সমুদ্দুরের মত। খাস্তগিরের নৌকা উল্টালো। পিঁপড়েগুলো চীৎকার করতে করতে জলে ভাসছে। খাস্তগির শুনতে পাচ্ছে। তবু কাছে যাচ্ছে না। যাবেও না। ওরা আসলে পিঁপড়ে না। সেজে এসেছে। ওরা নিমু, পটলা, পিকু। যারা তাকে অকারণে মারতে আসে। লুঙ্গি খুলতে চায় বাজারে গেলে। সিগারেট ছ্যাঁকায়। মরুক ওরা। বাজ পড়ছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। খাস্তগির সাঁতার কাটছে।
খাস্তগির জল থেকে উঠল যখন সন্ধ্যে। আজ খাবে না। বাড়ির ভিতর অন্ধকার। আজ কারেন্ট আসবে না। ঝড়ে তার ছিঁড়েছে। খাস্তগির ভিজে গায়ে কাঁথা চাপা দিয়ে শুয়ে পড়ল। খাস্তগিরের শীত করছে। বুকের কাছটা ঘড়ঘড় করছে। সারাটা শরীর অবশ হয়ে আসছে। তার গুড নাইট নিভে। নাইট বানানে ইংরাজির k অক্ষর আছে। খাস্তগির জানে এই নাইটের মানে রাত্তির নয়, যোদ্ধা।
আমি খবর পেলাম দু’দিন পর। লোকে বলল পাগলটা মরেছে। অবাক হয়েছিলাম। আজও ওর বাড়ির সামনে দিয়ে হাঁটতে গেলে গা ছমছম করে। তার বাড়িতে এখন নতুন লোক। সুস্থ লোক। তবু খাস্তগির যেন দাঁড়িয়ে কোথাও, সবার অলক্ষ্যে।