নতুন ইংরাজী বছরের প্রথম দিন। সকাল ১১টা হবে। কাজের গতি শিথিল। ছুটির আমেজ। গোসাঁই এল। সেই সাদা ধুতি, সাদা পাঞ্জাবী, হাতে একতারা, পায়ে ক্যাম্বিসের জুতো। বয়েস পঁচাত্তরের আশেপাশে হবে। শীর্ণ, কালো দেহ। চোখ দুটোর একটা আকর্ষণ আছে। কি একটা যেন ঘোর। সামনে দাঁড়ালে মনে হয় যেন গ্রীষ্মের দুপুরে বড় দীঘির পাড়ে এসে দাঁড়ালাম। মনটা শান্ত হয়ে যায়।
এসেই যথারীতি লালনের গান ধরলেন। উনি জানেন লালন আমার খুব প্রিয়। তাই আসলেই কয়েকটা গান শোনান। আসেন দু-তিন মাসে একবার।
গান সমাপ্ত হল। নিয়মমাফিক দশটা টাকা দিলাম। বললেন, দশ টাকায় তো হবে না দাদুভাই, (এই নামেই ডাকেন, যদিও দাদুভাই হওয়ার বয়েস পেরিয়েছি অনেক আগে)
একশো লাগবে। গঙ্গাসাগর যাব যে! বেশ খরচ।
দিলাম। দিয়ে বললাম, গোসাঁই এ পথে কতদিন হল?
সে বললে, তা বাইশ-তেইশ বছর তো হবে।
বললাম, সংসার করেছিলে?
বলল, হ্যাঁ।
আমি বললাম, তা ছাড়লে কেন?
সে বলল, মিথ্যা বলব না। আমার আশ্রমে আমার পরিবার আমার সাথেই থাকে।
আমার মন ধাক্কা খেল। মুখে বললাম, বুঝলাম না।
গোসাঁই বসল। অতীত তার শব্দের ভাণ্ডার খুলে বসল।
"আমি একটা ভাল কোম্পানিতে মোটামুটি চাকরী করতাম। ছেলেটা পড়াশোনায় খুব ভাল ছিল। তা সে ভেটেনারী ডাক্তারিতে চান্স পেল। ওরে পড়াবার মত অত টাকা কোথায় পাই। বাংলাদেশ থেকে উদ্বাস্তু হয়ে এসে কোনোরকমে মাথা গোঁজার ঠাঁই করতেই সব বেরিয়ে গেছে। যা হোক কোনোরকমে টাকা যোগাড় করে পড়ালাম। ভাল পাশ দিল। সরকারি চাকরি পেল। ভাল মাইনে।"
মনে মনে ভাবছি, এও তো বেশ, সন্ন্যাসীর সংসারের গপ্পো। তা হলে জীবনটা এরও এক পাল্লা না। দুই পাল্লা জীবনের আন্দোলনেই তো এ সংসার। কেউ এদিকে দোল খায়, কেউ ওদিকে। আবার কেউ এদিক ওদিক দুই দিকেই। যা হোক চিন্তা মুলতুবি থাক। আপাতত এর দোলনার কথা শুনি।
"ভাল ঘর দেখে বিয়ে দিলাম দাদুভাই। বৈশাখে বিয়ে হল। সংসার বলতে আমি আর আমার পরিবার, আমার মা, আর ওরা দু'জন। কি হল বুঝলাম না। আশ্বিনে সে ঘর ছেড়ে বউ নিয়ে চলে গেল। আমার মা সেই শোক নিতে পারল না। মারা গেল।"
আমি চুপ করে দাঁড়িয়েছিলাম। সে বসে বলে যাচ্ছে। তার গলা কাঁপল না। চোখ থেকে এক ফোঁটা জল পড়া তো দূরের কথা, ভিজল না পর্যন্ত। আমার মন ততক্ষণে মগডাল থেকে ধুলোয় পড়ে। একি নিষ্ঠুর! এতো উদাসীনিতা অভিমানে না সাধনে?
আমি কোনোরকমে সামলে বললাম, তারপর?
সে হাসল। সে হাসির বর্ণনা হয় না। এ মন তার নাগাল পায় না।
বলল, "আমার গুরু বললেন, কি রে সংসার তো দেখলি। কি পেলি?"
আবার সেই হাসি। আমার গলার কাছে কান্না জমছে। কল্পনায় তার ছেলের মুখটা আনার চেষ্টা করছি। কতটা উন্নতি করলে বাবা-মায়ের পরিচয়টা লজ্জার কারণ হয় ভাবার চেষ্টা করছি।
গোসাঁই বলল, "আমার গুরু জিজ্ঞাসা করলেন, কি পেলি সংসার করে?
আমি বললাম, কিচ্ছু না।
গুরু বললেন, গোবিন্দের চরণে দে এবার বাকি জীবনটা। সেবা কর। নামগান কর। মানুষের দ্বারে দ্বারে যা। মানুষকে নাম শোনা। পরিত্রাণের পথ বল।"
গোসাঁই-এর মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠল। বলল, সেই ঘর ছেড়ে আশ্রম বাঁধলাম। সংসারী থেকে হলাম ফকির। এই আনন্দে আছি, বেশ আছি।
তার চোখদুটো উজ্বল হয়ে উঠল।
দু'জনেই চুপ করে রইলাম। আমার মন আভিজাত্যের, শিক্ষিতের অহংকারের টুকরোর উপরে বসে। কান্না সামলাচ্ছে। একবার মনে হল ওঁকে একটিবার আলিঙ্গন করি। পারলাম না। বাধ সাধল আমার সভ্যতার শিক্ষা। সার্টিফিকেটের পাহাড়। তবু ভাবছি, এত সহজ ওনাকে কে করল? অভিমান, আক্রোশ, দুঃখ - কোন হোমাগ্নিতে আহুতি দিলেন? এত শক্তি, এত উপেক্ষা সহ্য করার মত ক্ষমতা কোথায় থাকে মানুষের? নিজেকে কতটা খুঁড়লে সে নগরের দ্বারে পৌঁছানো যায়? যিনি অন্য মানুষের ভিক্ষার ঝুলি ভরতেন, তিনি আজ আমার দরজায়।
জিজ্ঞাসা করলাম, ছেলে কোথায় এখন?
বললেন, সে আমার খবর নেয় না, আমিও নিই না। তবে শুনেছি কলকাতায় থাকে এখন। বড় বাড়ি করেছে। অনেক মাইনে। আমার কি বলো দাদুভাই। সে ভাল থাক।
আর দু'একটা কথার পর সে বিদায় নিল। আগামী চৈত্রে আমন্ত্রণ রইল তার আশ্রমের উৎসবে যোগ দেওয়ার। রাত্রিবাসেরও - "দেখে এসো দাদুভাই, এই ভিক্ষার চাল নিয়ে আমরা শুধু নিজেরা খাই, নাকি মায়েন্সের (মানুষের) সেবাও করি।"
আমার ভাবনাচিন্তা কি ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে রইল। কতরকম জীবন, কতরকম উপলব্ধি। কতটা জানি, কতটা বুঝি? যা পড়ে জেনেছি আর যা পঞ্চেন্দ্রিয় দিয়ে আহরণ করে চলেছি, তাদের মধ্যে কোনো মিলই খুঁজে পাওয়া দায়। পাশ্চাত্য দর্শন, হাজার একটা মনস্তাত্ত্বিক তত্ত্ব, সব আমার কাছে কেমন ফিকে হয়ে গেল এক নিমেষে। কিছুই বুঝলাম না মনের বিচিত্র গতি। মানুষ যাকে পেলে সংসারে এতটা মুক্ত হয়ে ফেরে, তার হদিশ তো পেলুম না। এদের চলার পথেই আমার চলার পথটার অন্তত কয়েকটা পদক্ষেপ এঁকে নিই, তাতে যদি কিছুটা খামতি পূরণ হয়।