সৌরভ ভট্টাচার্য
6 January 2020
হয় তো একটু সরব চিন্তা করতে চাইছি। নিজের চিন্তার জট ছাড়াতে চাইছি। যে ঘটনাটা দিল্লীর বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে গেল, তাকে ধিক্কার জানানোর মত ভাষা আমার নেই। আমি সমস্যাটাকে আবারও খুঁড়ে দেখতে চাইছি। আবেগে, ভাবে ভেসে রাজনীতি হয় না। আর আজ দেশ আর রাজনীতিকে আলাদা করে দেখার জায়গায় আমরা কেউ নেই।
প্রথম কথা, যদি আজ আমাদের মনে হচ্ছে দেশের ভাবমূর্তি, দেশের সেক্যুলারিজম বিপন্নতার দিকে এগোচ্ছে, তবে সে দায় শুধু কোনো একটা বিশেষ দলের আর সরকারের বলে আমরা দায় এড়াতে পারি না। আমরা একটা গণতন্ত্রে বাস করি। যখন আমরা খুব গর্বের সাথে অফ দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল - স্লোগানে নিজেকে ব্যাখ্যা করতে চাই, তখন মনে রাখতে হবে এর দায়টাও আমার উপর বর্তায়, কারণ ওখানে ‘বাই দ্য পিপল’ বলে একটা বাক্য ব্যবহার করছি। তাই দায়ভার কোথায় আমার সেটাও দেখতে হবে।
গণতন্ত্রে দুটো বড় শব্দ – সংখ্যা আর প্রভাব। এটা একটা চক্র। আজ যদি দক্ষিণপন্থী, কি হিন্দুত্বপন্থী সরকার বলে আমরা চীৎকার করছি, তবে মনে রাখতে হবে, বহুবছর তথাকথিত লিবারেল, সেক্যুলার সরকারের অধীনে থাকা ভারতের জনমতই আজ এই বিপুল সংখ্যায় এই সরকারকে এনেছে। অর্থাৎ ধীরে ধীরে তারা তাদের জনমত তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। অন্যেরা ব্যর্থ হয়েছে। এটা বাস্তব। ভোটের হিন্দী শব্দটার অর্থ অনেক স্পষ্ট – মতদান। অর্থাৎ সেই দিকের পক্ষে জনমত তৈরি করতে তারা সক্ষম হয়েছে, ও বিপুল সংখ্যায় হয়েছে। আবার অনেকে দেয়ও নি, গণতন্ত্রে সেটাও সত্য। কিন্তু সংখ্যার খেলায় তারা পিছিয়ে।
এরপরের কথাটা হল – প্রভাব। রবীন্দ্রনাথ বলছেন একটা চিঠিতে, মহাত্মার সাথে তার মতের অনেক পার্থক্য হলেও তিনি নিরুপায় কারণ মহাত্মার প্রভাব জনগণের উপর বেশি। এই ‘প্রভাব’ শব্দটা মারাত্মক শক্তিশালী গণতন্ত্রে। জনগণের মধ্যে নিজের প্রভাব বিস্তার করার ক্ষমতা গণতন্ত্রে একটা প্রধান অস্ত্র, কৌশল। এর কোনো নীতি নেই, এ কৌশল নির্ভর। এইখানেই গণতন্ত্রের সীমাবদ্ধতা। জনপ্রিয়তাই মানুষের নেতা হওয়ার মূলধন, সুনীতি ইত্যাদি নয়, সে সূক্ষ্ম বিচারের সময় জনতার নেই। তবে সে জনমত গঠন করা সম্ভব, মোড় ফেরানো সম্ভব, বহু দেশের রাজনীতির ইতিহাস এর সাক্ষী।
এখানেও আমাদের স্বীকার করতে হবে আমাদের এখনও অবধি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী তুল্য-সমক্ষ প্রতিদ্বন্দ্বী নেই কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক মহলে। জনপ্রিয়তাতেও নেই। যদিও অনেকের মতে তা কমছে। সে প্রমাণসাপেক্ষ, আমাদের অপেক্ষা আরেকটা ব্যালটযুদ্ধের।
এ সব কথাই আমাদের জানা। তবে উপায় কি? একটা কথা স্পষ্ট, যে দায় আমাদের নিতেই হবে। দেশ রাজনীতিতে চলে। গণতন্ত্রে রাজনীতির বাইরে কেউ নেই। কেউ প্রত্যক্ষ, কেউ পরোক্ষ। “লড় কে লেঙ্গে আজাদী” ইত্যাদি শুনতে ভালো, গায়ের রক্ত গরম করে, অ্যাড্রিনালীন উৎস্রোত ঘটে মানলাম, কিন্তু মনে রাখতে হবে, শেষ যুদ্ধটা হবে ব্যালট বক্সে। সেই ব্যালট বক্সে হবে মতদান। জনমত কি ওভাবে গঠিত হবে? সেকি একদিন, একমাস, এক বছরের কাজ? জনগণের সাথে মিশে গিয়ে, জনগণের সাথে থেকে, দীর্ঘদিন ধরে লড়াইয়ে একটা জনমত তৈরি হয়। এ শুধু আবেগের কাজ না। এ শুধু জ্বালাময়ী ভাষণের কাজ না। এ কৌশলের কাজ। এ দীর্ঘ ধৈর্য, আত্মসমীক্ষা, খাঁটি জনসংযোগের কাজ। যদি সে ক্ষমতা না থাকে, যদি সে দৃঢ় সঙ্কল্পের জোর না থাকে, তবে শুধুমাত্র স্লোগানে, চীৎকারে, আবেগে কাজ হবে না। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ের স্ট্র্যাটেজী, আবেগের পুনরুত্থান করে এই সমস্যার সমাধানের পথ মিলবে কি? সেদিনের সাথে আজকের সময়কে গুলিয়ে ফেললেও হবে কি করে? উপায় দুটো, এক প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বের খোঁজ, দুই জনমত তৈরির দীর্ঘমেয়াদী ধৈর্যশীল পথ। এই দুটো শক্তি না থাকলে আদতে সবটাই ব্যর্থ। কারণ প্রতিবাদের ভাষা প্রথম ধাপ, পরের ধাপ সংগঠনের ভাষা। কি গঠন করতে চাইছি সেই ছবিটাকেও স্পষ্ট করতে হবে। সেই ছবির প্রতি জনগণের বিশ্বাস অর্জনের চেষ্টা করতে হবে। তাদের ধোঁয়াশা, সংশয়ের জবাব দিতে হবে। আজ যদি দেশটাকে ধর্মের নামে ক্ষেপিয়ে দেওয়া যায়, তবে প্রশ্ন শুধু অগ্নিসংযোগের দিকে না করে এতদিন ধরে তাজা বারুদ কিভাবে এতগুলো বছরের সেক্যুলার সরকারের চোখ এড়িয়ে গেল, সে প্রশ্নও করতে হবে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা, সমাজের নানা রীতিনীতিকে প্রশ্ন করতে হবে যা এই বারুদকে জাগিয়ে রাখছে। নিরপেক্ষভাবে নিরাময়ের চেষ্টা যদি আন্তরিকভাবে করা যায়, তবে শুধু বাংলাদেশ-আফগানিস্তান-পাকিস্তানের নাম না এসে জাপানের নামও উচ্চারিত হতে পারত, যারা অন্যভাবে পেরেছে এই কাজটা বলে। ইতিহাসে অন্ধকার যুগ থাকাটা আশ্চর্যের নয়, আশ্চর্য সেই অন্ধকারের লিগ্যাসি বহন করার, এবং তাকে প্রত্যক্ষভাবে, কেউ পরোক্ষভাবে মদত জুগিয়ে যাওয়ার। সেকি শুধু আজকেই হচ্ছে? না, এর বীজ অনেক গভীরে। ভারতের গ্রামে গ্রামে ঘুরলে বোঝা যায়, শিক্ষা শুধুই জীবিকা আনলে আর চেতনা না আনলে কি ঘোরতর অন্ধকার আলোকবৃত্তের কেন্দ্রেই রচিত হয়।
অবশ্যই শুধুই কি গ্রাম? একটা উদাহরণ দিয়ে শেষ করি। যে দেশে পরতে পরতে ধর্মের বেড়ি, সেই দেশে ধর্মকে এড়িয়ে শিক্ষাব্যবস্থা না করে, সব ধর্মের মূলে যে এক সত্য তাকে সামনে আনাটা আরো বেশি জরুরী। যেমন যে দেশে সাপের উৎপাত খুব বেশি, সে দেশে "আমি সাপ মানিনে" বলে চলাটা মূর্খামি, সেরকম সঠিক রাস্তায় এই ধর্মে বাঁচা দেশটাকেও নিয়ে চলাটা যুক্তিযুক্ত। নইলে মহাত্মা, রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ প্রমুখ সমাজসংস্কারকেরা সব ধর্মশিক্ষাটাকে শিক্ষার মূল অঙ্গর সাথে যুক্ত করার কথা ভাবতেন না। সবাই ইতিহাস পড়ে যেমন ইতিহাসবিদ হয়ে যায় না, তেমনই সবাই সব ধর্মের ইতিহাস আর তাদের সাধারণ নৈতিক অনুশাসনগুলোর সাথে পরিচয় থাকলে কেউ ফকির সন্ন্যাসী হয়ে যায় না। বরং একটা সুপরিকল্পিত পথে, সঠিক পথে ধর্মগুলোর সাথে পরিচয় ঘটে। যত বিরোধ অজ্ঞানতা, অজ্ঞতা থেকে। কিন্তু শিক্ষাটা হলে তখন কেউ কাউকে যা খুশী শিখিয়ে দিতে পারে না। একটা ন্যূনতমজ্ঞান হয়েই যায়। কিন্তু শুধুই জীবিকামুখী শিক্ষা তা পারে কি?