বাচ্চাটা বারবার গোলাপটার দিকে হাত বাড়াচ্ছে। যতবার হাত বাড়াচ্ছে ততবার অস্বস্তিতে পড়ছে অনোখ। ভাতিণ্ডা থেকে বিরাশি বছরের মাকে নিয়ে এসেছে শিরডি, সঙ্গে অবিবাহিতা বোন, কুসুম। তার মায়ের ভীষণ ইচ্ছা সাঁইবাবার মন্দিরে আসবে। অনোখের জন্মের আগে থেকেই নাকি মানত ছিল মায়ের। আসা হয়নি। গরীবের পক্ষে চৌকাঠ পেরোনো হিমালয় পেরোনোর সমান।
গতকাল মাকে বোন নিয়ে এসেছিল মন্দিরে। অনোখের সময় হয়নি। সে আসলে একটা ব্যবসার কাজ নিয়ে এসেছে শিরডি। ভাতিণ্ডাতে তার ছোটোখাটো একটা ব্যবসা। আর সেই জন্যেই শিরডি আসা। মায়ের জেদ, সেও আসবে। তাই মা আর বোন সঙ্গে এলো।
বাচ্চাটা বাবার কোলে। লাইনে তার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। বারবার বলছে, রোজ… রোজ… আর হাত বাড়াচ্ছে। ওর বাবা বকছে। অনোখের খারাপ লাগছে। ইচ্ছা করে দুবার একটু পিছিয়েও গিয়েছিল লাইনে। কিন্তু কি করে, কি করে আবার সামনে চলে এসেছে বাচ্চাটা। মনে হয় না বাচ্চাটার বয়েস দু’বছরও হয়েছে বলে।
অবশেষে অনোখ পারল না। দিয়ে দিল গোলাপটা বাচ্চাটাকে। তার বাবা ভীষণ লজ্জা পেয়ে বলতে লাগল, একি করলেন… আপনি এটা বাবাকে দেবেন বলে লাইনে দাঁড়িয়ে… ছি ছি, এটা খুব অনুচিত হল।
কথায় কথায় অনোখ জানল, বাচ্চাটার রক্তের কি একটা জটিল অসুখ আছে। খুব একটা আশা নেই। অনোখ ক্লাস এইট অবধি পড়াশোনা করেছে। অতশত ডাক্তারি শব্দ বোঝে না। কিন্তু সবটা জানার পর তার আর ইচ্ছা করল না বাচ্চাটার পিছন থেকে নড়ে। ওর বাবার কোল থেকে চেয়ে কোলে নিল। লাইন অনেক লম্বা। মনে হয় ঘন্টা দুই লাগবে। বাচ্চাটা চলে এলো। অনোখ জানল ওরা বিহার থেকে আসছে। ওর বাবা চাষী। বাচ্চাটার চিকিৎসার জন্য জলের মত টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে। অনোখ সব শুনছে। নিজের বাবাকে মনে পড়ে না। অনেক ছোটোবেলায় মারা গেছেন। অনোখের মাথার মধ্যে তার পাঞ্জাব, বিহার সব এক হয়ে যাচ্ছে। মানুষের অসহায়তার, দুঃখের কোনো সীমা, ভাষা হয় না।
বাচ্চাটা তার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে গেছে। ওর বাবা দু একবার চাইল। অনোখ দিল না। থাক। কতক্ষণই বা লাগবে আরো। দু ঘন্টা যেন কয়েক মিনিট। স্নেহ বড় আশ্চর্য জিনিস। অনোখের একটা বাচ্চা। ছেলে, চার বছর বয়েস। ওরা আসেনি। অনোখ জানে এত খরচা সামলাতে পারবে না বলেই নূর এড়িয়ে গেছে। বলেছে গুণীতের পড়াশোনার ক্ষতি হবে। মিথ্যা কথা। দুজনেই জানে। তবু অনেক সময় কিছু মিথ্যা সত্যির চেয়ে বেশি সত্যি।
অনোখের কাঁধে বাচ্চাটার মুখের লালা লাগছে। ভিজছে। অনোখের মনটা ভিজে যাচ্ছে লালায়, নিজের ছেলেটার জন্য, কাঁধের মাথাটার জন্য… এইটুকু প্রাণ… ভগবান নিও না… থাক না আর কদিন…
অনোখ চোখের জলটা সামলে নিল। বাইরে না আসুক।
মন্দিরে সাঁই দর্শন হল। বাচ্চাটাকে টাটা করে, একটু আদর করে বেরিয়ে এলো। হোটেলে যেতে ইচ্ছা করছে না। সাঁইয়ের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের জন্য কিচ্ছু চাইতে পারেনি। শুধু বাচ্চাটার জন্যে প্রার্থনা করে এসেছে। ও বাঁচুক। আর কিছু না। শুধু ও বাঁচুক।
একটা চায়ের দোকানে দাঁড়ালো। চা দিতে বলে, ফোনটা পকেট থেকে বার করল। বাড়িতে ফোন করল। ধরল নূর।
কথা বলার কিছু নেই। মন্দিরে ঢোকার আগেই ফোনে কথা হয়েছে। নূর বলল, কিছু হয়েছে?
অনোখ বলল, মিস করছি গুনীতকে, তোকে।
নূর চুপ করে থাকল কিছুক্ষণ। অনোখ জানে নূরের কাজল এখন সজল। তার টাটানো নাকের মত। এসব কথা বলা অভ্যাস নেই। কিন্তু এখন এটাই সত্যিই কথা। বাকি সব মিথ্যা। নূর খানিকবাদে বলল, তোমার ছেলে অনেক বড় হয়ে গেছে… মালী হয়েছে সে এখন…
অনোখের ঘোর কাটল যেন। চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, কেন?
নূর বলল, আরে এই খানিক আগে ওর রহিম আঙ্কেলের সঙ্গে মার্কেটে গিয়েছিল। একটা গোলাপের চারা নিয়ে ফিরেছে। সে এখন সারাদিন টবে সেই গাছ নিয়ে পড়েছে। জল দেয় দু’বেলা। গাছটার সঙ্গে কত কথা বলে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম গাছ কোত্থেকে পেলি? তো রহিম বলল, ওর বাড়ির জন্য গাছ কিনছিল, তখন ও নাকি বায়না করে ও একটা গাছ কিনবে। ওর এই গোলাপটাই পছন্দ। রোজ… রোজ… করে নাকি ভীষণ বায়না শুরু করেছিল… আসলে তুমি ওকে নিয়ে যাওনি বলে ওর খুব অভিমান হয়েছিল। তারপর অনেক বুঝিয়ে রাজি করিয়েছি যে তুমি এলেই ওকে নিয়ে আমরা ওর মামাবাড়ি যাব… এইসব আর কি… তাই আমিও আর কিছু বলিনি ওকে… তবে রহিম টাকাটা নেয়নি কিন্তু…
অনোখের সামনে সব কিছু ঝাপসা। তার চোখের সামনে ভেসে উঠল বাচ্চাটার মুখ, তার ভেজা কাঁধ, তার তাকে দেওয়া গোলাপ। সে বলল, ও কোথায়?
গুণীত ফোন নিল। নিয়েই ভিডিও অন করে দিল। তারপর দৌড়। ছাদে উঠল। একটা টবে একটা গোলাপের চারা। বিকেলের হাওয়ায় দুলছে অল্প অল্প। গুণীত নিজের দিকে ক্যামেরাটা ঘোরালো… বলল, তুমি আসার আগেই ফুল ফুটে যাবে দেখো… রেড রোজ… তোমার ফেবরিট কালার… না?
অনোখ বলল, তুই তো আমার গোলাপ… তোর জন্য কি আনব?
গুণীত একটু ভেবে বলল, চিপ্স… আর ওর জন্য একটা কিউট জামা…
ওর জন্যে মানে গোলাপের জন্য…