Skip to main content

কোন চিকিৎসকের কাছে না গেছে লোকটা? কেউ সুরাহা দিতে পারেনি। বিদেশেও গেছে, কেউ কেউ বলে। নিন্দুকেরা বলে, উঁ! বিদেশ গেছে না ছাই... সুন্দরবনে গিয়ে সেঁধিয়ে ছিল। সে যাই হোক, লোকটা চেষ্টার অন্ত রাখেনি। তার একটাই সমস্যা – কেন কুড়িটা নখ আর তেত্রিশ হাজার উনপঞ্চাশটা মাথার চুল বেড়ে বেড়ে যাবে প্রতিদিন, প্রতিমাস, প্রতিবছর। সব চিকিৎসকের একটাই কথা – এটাই প্রকৃতির নিয়ম। তারও একটাই কথা – নিয়ম বলেই মানতে হবে? ব্যক্তিগত স্বাধীনতা বলে কিছুই কি নেই তবে? প্রকৃতি কি তবে ফ্যাসিস্ট?
        লোকটা এই নিয়ে বক্তৃতা দিল, ইস্তাহার ছাপালো, বিজ্ঞানীদের যে কত চিঠি লিখল সে নিজেও গুনে শেষ করতে পারে না। কিন্তু কোনো ফল নেই। চারদিকের মানুষগুলোর দিকে তাকায় আর দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মনে মনে বলে, হায় রে প্রকৃতির দাস! লোকে হাসে, লোকে চটে। ওর করুণা আরো বেড়ে যায় হুহু করে। স্বাধীন চিন্তার অভাবে মানুষের যা অবস্থা হয় – এদেরও তাই হয়েছে। নিজেদেরকে দাস করে বাঁচা এদের অভ্যাস। নিন্দুকেরা বলল, আঙুল কেটে ফেলো... মাথাটা কেটে নাও... তবেই তো ল্যাঠা চুকে যায়। লোকটা তিন-চার মাস ভাবল কথাটা। কথাটা যে একেবারে উড়িয়ে দেওয়ার মত, তা নয় কিন্তু। এও তো একধরণের বিদ্রোহ –আত্মত্যাগ। পরের গোলামি করার চাইতে এ অনেক ভালো। কিন্তু লোকটার একটা দুর্বলতা ছিল – দোক্তাপাতা। সে দিনে চারবার দোক্তাপাতা চিবোতো। বর্ষাকালে সেটা বেড়ে আট-দশবারও হয়ে যেত। তো হল কি, লোকটা দোক্তাপাতার জন্য প্রাণটা দিয়ে উঠতে পারল না। কিন্তু প্রস্তাবটার জন্য নিন্দুকদের সাধুবাদ জানালো। নিন্দুকেরা ভড়কে গিয়ে পাড়া ছাড়ল, পাছে লোকটা কিছু করে বসে আর তাদের নাম লিখে যায়। তারপর বাকিটা জীবন জেলেই কাটুক আরকি!
        লোকটা বিমর্ষ হয়ে গেল। বিয়ের বয়েস পেরিয়ে গেল, বিয়ে করল না। কারণ সে সব মেয়েদেরকেই এই একই প্রশ্ন করত, তারা এর কোনো সমাধান জানে কিনা... কিম্বা এটাকে প্রকৃতির স্বৈরাচার বলে অন্তত মনে করে কিনা? মেয়েরা হাঁ করে তার মুখের দিকে চেয়ে থাকত। বাড়ির মশা-মাছি সেই হাঁ মুখে ঢুকে একচক্কর খেয়ে বেরিয়ে আসত। লোকটা হাঁ করে দেখত – মশা-মাছির লোম হয় কিনা। একটা মেয়ে তাকে ভয়ানক দুশ্চিন্তায় ফেলল, বলল, দেখুন সুচিন্তক মহাশয়, এই কেশঘটিত সমস্যাটি কিন্তু কেবল মস্তকের কেশ লইয়াই ঘটিয়া থাকে। আপনি বিবেচনা করিয়া দেখিবেন গণ্ডদেশের নিম্ন হইতে উৎপন্ন নানা প্রদেশের দুষ্টু কেশরাজি আপনাকে সীমায়িত করিয়া রাখিতে জানে, তাহারা প্রগলভ নহে। অর্থাৎ...
        বাকিটা শোনার মত আর ধৈর্য ছিল না আমাদের চিন্তক মহাশয়ের। তিনি চিন্তায় এত মগ্ন হয়ে গেলেন যে হৃৎপিণ্ডের কয়েকটা বিট মিস করলেন, কয়েকবার শ্বাস নিতে ভুলে গিয়ে প্রায় অজ্ঞান হওয়ার জোগাড় হল। কন্যার মাতা-পিতা কন্যার এই বাক্য শুনে সেই যে মাটিতে দাঁত ছড়কুটে পড়লেন মাসাবধি স্যালাইনের মাধ্যমে তাদের জীবিত রাখার প্রয়াস চলল। সুচিন্তক ঘরে খিল দিয়ে চার বছর নিজেকে অবরুদ্ধ রাখলেন। চার বছর অপেক্ষা করার পর লোকজন যখন ঘরের দরজা ভেঙে ঢুকতে গেল, দেখল দরজাটা কিছুতেই খোলা যাচ্ছে না। তখন আশপাশের শহর, মফস্বল, গ্রাম থেকে আরো আরো লোক জড়ো করে তুমুল ধাক্কাধাক্কি করে দরজা খোলা হল। মানে ভাঙা হল। দরজাটা ভেতরের দিকে তো গেলই না, বাইরেই ভেঙে সরাতে হল। ঘরের ভিতর থেকে সাতশো তেরোটা চামচিকে, তিনশো আঠারোটা খরগোশ, বারোশোর উপর কেঁচো, তিরিশ হাজারের মতন মাকড়সা বেরিয়ে এলো কিলবিল করে। ঘরের মধ্যে বটগাছের ঝুরির মত নখ আর শ্রাবণের মেঘের মত ঘন কালো চুলে ভরতি। লোকটাকে আর খুঁজেই পাওয়া গেল না। চুল সরাতে সরাতে সবাই ভেবেছিল মাথাটা পাওয়া যাবে। গেলই না। নখ কাটতে কাটতে ভেবেছিল আঙুলগুলো পাওয়া যাবে। তাও পাওয়া গেল না। কত লোক হারিয়েই গেল চুলের ঘন কালো অন্ধকারে। কত লোক নখ কাটতে কাটতে বুড়ো হয়ে গেল। অবশেষে ঘরটা যখন প্রায় পুরো ফাঁকা, তখন একটা গোঙানির শব্দ শোনা গেল। সবাই তন্নতন্ন করে চারদিক খুঁজে দেখল, খুঁড়ে দেখল। কিচ্ছু পাওয়া গেল না। কিন্তু গোঙানির আওয়াজটা সবাই শুনেছে। তারা বাইরে থেকে গুণিন আনালো। সেও পেলো না। বিজ্ঞানীদের আনানো হল। তারাও পেলো না। 
        দিন গেল, মাস গেল, বছর গেল। বহুদিন হয়ে গেল। লোকে ভুলেও গেল এসব কথা। বাড়িটা ভেঙে এখন একটা শপিং মল হয়েছে। চারদিকে মেট্রোর লাইন খোঁড়াখুঁড়ির কাজ চলছে। একদিন এক শ্রমিক মাটির নীচে একটা অনেক বুড়ো মানুষকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে সে তার বড়সাহেবের কাছে খবর দেয়। বড়সাহেব তার বড়সাহেবকে খবর দেয়। তিনি এসে লোকলস্কর লাগিয়ে সেই বুড়োকে বাইরে নিয়ে আসেন। কেউ চিনতে পারে না সেই বুড়োকে। তার না আছে আধার কার্ড, না ভোটার কার্ড। অবশেষে মল্লিক পাড়ার নেরুনোশি ঠাকুমা চিনতে পারেন। তাঁর বয়েস তখন একশো পঁচিশ। তার মনে পড়ে বহু বছর আগে ইনিই তাকে বিয়ে করতে গিয়ে নখ আর চুলের একটা প্রশ্ন করেন। তিনি তখন তাঁকে সুকৌশলে এড়িয়ে গিয়ে প্রসঙ্গান্তরে নিয়ে যাওয়ার জন্য দেহের অন্যান্য কেশের সাথে তুলনায় আনেন। উনি উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে যান। ওনার মা-বাবা'র একবার জ্ঞান ফেরার পর আর স্মৃতি ফেরে না। তিনিও অবিবাহিত থেকে যান। বুড়োও নেরুনোশিকে চিনতে পারে। কিন্তু বুড়োর নখ আর চুল না থাকায় তাকে যা বিটকেল দেখায়, তিনি লজ্জায় মাথা নীচু করে গ্রাম থেকে গুটিগুটি পায়ে বেরিয়ে আসেন। কিছুদূর আসার পর একটা আমগাছের নীচে বসেন। অনেকদিন পর বাইরের আলোতে মাথাটা কিরকম ঝিম ধরে আসে। ঝিমের মধ্যে দেখেন আকাশ থেকে বিশাল চুলের সারি নেমেছে। সেই চুলের সারি ফাঁক করে তাকিয়ে আছে নেরুনোশি। তার হাতে দোক্তাপাতার ডিবে। সুচিন্তকের ঠোঁটের আগায় একটা তিন সিকে হাসির রেখা খেলে যায়। তিনি হঠাৎ খেয়াল করেন কে যেন তার পায়ে হাত রাখল। তাকিয়ে দেখে, নেরুনোশি। নেরুনোশি সে তাকাতেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলেন, বলেন, আমার জন্যেই তোমার এই দুর্গতি, সেদিন ওই কথাটা না বললে আজ...
        সুচিন্তকের মাথার মধ্যে যেন ভোরের পাখির কিচিরমিচির ডাক শুরু হল। তার আঙুলগুলো দিয়ে যেন বর্ষার জলে প্রাণ ফিরে পাওয়া শুষ্ক নদী জেগে উঠল। তিনি অনুভব করলেন, এতদিন মাথার স্বাধীনতার কথা ভাবতে ভাবতে বুকের পরাধীন থাকার সাধটার কথা ভুলেই গেছেন। হৃদয়ের পরাধীন হওয়ার ইচ্ছাটা জাঁকিয়ে বসল তাকে, তিনি উঠে গিয়ে নেরুনোশিকে জড়িয়ে ধরে একটা চুমু খেলেন। দু'জনেরই দাঁত না থাকার জন্য মুখের মধ্যে একটা ডাবা খেলেন দু'জনেই। সামলে নিয়ে আবার চুমু খেলেন। সুচিন্তকের মাথাটা চুলকাতে শুরু করল হঠাৎ করে, আঙুলের ডগাগুলো সুড়সুড় করতে লাগল। এমন সময় একজন ছুটতে ছুটতে এসে খবর দিল নেরুনোশির বাবা-মা পদ্মমাছি আর নোলককালির স্মৃতি ফিরে এসেছে, তারা জিজ্ঞাসা করছে গান্ধীজির অনশন ভেঙেছে কিনা...
        স্বভাবতই গাঁয়ে হুলুস্থুলু পড়ে গেল। বিয়ের ব্যবস্থা করা হল সরকার থেকে। সুচিন্তককে গোলুমালু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি-লিট দেওয়া হল। আর হিন্দুজাগরণী সভা থেকে নেরুনোশিকে শবরী উপাধি দেওয়া হল। একটা বিরাট সভার আয়োজন করা হল। ডক্টর সুচিন্তক মহাশয় একটা গুরুগম্ভীর বক্তৃতা দিয়ে শেষে বললেন, পৃথিবীতে যারা হৃদয়কে প্রেমের অধীন না করে মস্তিষ্ককে স্বাধীন করতে গিয়েছেন তারাই জগতে অকল্যাণের বীজ পুঁতেছেন।