Skip to main content
গো-সঙ্গ

 ব্যায়াম করা যে স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো, এই নিয়ে কোনো সন্দেহ কোনোদিন ছিল না পরাশর কবিরাজের। কিন্তু মুশকিল হল আজকাল ব্যায়াম করতে গেলেই ঘুম পায়। আর ঘুম পেলেই স্বপ্ন দেখেন। স্বপ্ন দেখে ক্লান্ত হয়ে গিয়ে ঘুম ভেঙে যায়, বেজায় খিদে পায়, বেশি খেয়ে ফেলেন, আর ওজন বেড়ে যায়। 
        আজ ওজন করেছেন, বিরাশি কেজি হয়েছে। নিজেকে কেমন গরু গরু লাগছিল ওজন করার পর থেকেই। তারপর মনে হল গরুর ওজন কত হয়? নেটে চেক করে দেখলেন ১০০০ কেজিও নাকি হতে পারে। মনটা একটু শান্ত হল। যদিও বয়েস হয়েছে বাহান্ন, তবু গরুর সাথে নিজেকে তুলনা করার অভ্যাসটা ছাড়তে পারেননি এখনও। বাবা, মাষ্টার, আত্মীয়, প্রতিবেশী, স্ত্রী, শালি ইত্যাদিদের কাছ থেকে এই প্রাণীটার সাথে নিজের এমন একটা তুলনা শুনে শুনে বড় হয়েছেন, বুড়ো হচ্ছেন যে গরু দেখলেই এখন কেমন বিহ্বল হয়ে পড়েন। বাইরে প্রকাশ করেন না যদিও, কিন্তু মনের মধ্য একটা ধাক্কা লাগে। আগে অপমান লাগত, এখন নিঃসঙ্গতা কমে। একা লাগলেই পরাশর বাবু গরু খোঁজেন এখন। গরুর কাছে দাঁড়ান, চোখের উপর চোখ রাখেন। মনটা হাল্কা হয়ে যায়। একবার ভেবেছিলেন একটা গোরক্ষা কমিটির সদস্য হবেন, কিন্তু হননি। ঠিক মানিয়ে নিতে পারেননি নিজেকে। গরুর থেকে যেন ওদের নিজেদের ভাবের উপরই দরদ বেশি মনে হয়েছিল। 
        আজ সকাল থেকেই পরাশরবাবুর মনটা খারাপ। বৃষ্টি পড়ছে সকাল থেকে। অফিস যাওয়াটা হল না। হয়েছে কি, অফিসে যাওয়ার আগে রোজ বত্রিশটা ডন দেন, আজ বারোটা ডন দেওয়ার পরই কেমন ঝিম ধরে আসে, স্বপ্নে ঢুকে পড়েন। তিনি এভারেস্টে উঠছেন, পিছনে পিছনে রতন ঘোষের সাদা গরুটা। কত দুধ খেয়েছেন ওর। ওকে নিয়ে যাচ্ছেন কৈলাসে। ওটা নাকি এভারেস্টের পৌরাণিক নাম, এটা তার নিজের মত। পরাশরবাবুর ইচ্ছা তিনি শিবের দর্শন করবেন, আর মতির ইচ্ছা সে শিবের ষাঁড়ের দর্শন করবে। অনেক বলে কয়ে রতনকে রাজি করিয়ে গরুটাকে, মানে মতিকে আনতে পেরেছেন। কিন্তু মুশকিল হল বেশ কিছুটা উঠে মতি আর চলতে চাইছে না। মানে পারছে না আরকি। এদিকে পিঠে দুবস্তা বিচুলি, সাথে চোদ্দো কিলো ছাতু নিয়ে পরাশরবাবু পড়েছেন মহা মুস্কিলে। বিচুলি আর এই বরফের দেশে কোথায় পেতেন, তাই বিচুলি আর ছাতুটা সঙ্গে নিয়েছেন। তবে ছাতুটা নিজের আর মতি দুজনের জন্যেই। হঠাৎ দেখেন দুজন মানুষ দূর থেকে হেঁটে হেঁটে গল্প করতে করতে আসছে। কাছে আসতেই খুব চেনা চেনা লাগতে লাগল, মনে পড়ল, আরে এতো তেনজিং নোরগে আর নীল আর্মস্ট্রং। নোরগের ব্যাপারটা বুঝলেন, কিন্তু এই আর্মস্ট্রং এখানে কেন? যাকগে প্রথম পরিচয়ে এত কথা জিজ্ঞাসা করা যায়? তিনি কিছু একটা ওদের বলতে যাবেন, হঠাৎ হুড়মুড় শব্দ শুরু হল, পায়ের তলার মাটি, থুড়ি, বরফ কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল। হঠাৎ তেনজিং বলে উঠল, ভাগো ভাগো... বলেই ছুটতে শুরু করল। পরাশরবাবু দেখলেন দূরে একটা ষাঁড় বরফের ঢেউ তুলে, সারা আকাশ বরফের মেঘে ঢেকে এদিকে এগিয়ে আসছে। শিবের ষাঁড়। মতি বিহ্বল হয়ে উঠল। তিনি যত বলেন, ওরে তাড়াতাড়ি পালা মতি, আর মতি, কে কার কথা শোনে। ষাঁড়টা প্রায় ঘাড়ে এসে পড়ে এমন সময় ঘুম ভেঙে গেল পরাশরবাবুর। দরদর করে ঘামছেন। বাইরে বৃষ্টিটা বেশ জোরেই পড়ছে। ঘড়ি দেখলেন, বারোটা পঁচিশ। বাড়িতে কেউ নেই যে তাকে ডেকে দিত, বউ আর মেয়ে বাপের বাড়ি গেছে। অফিসটা কামাই হল। 
        দুপুরটা ঘুম হল না। ভাত খেয়ে সারা দুপুর পাঁজি পড়ে কাটালেন। স্বপ্নযোগের কোনো রহস্য বের করার ইচ্ছা ছিল হয়ত। হল না। বিকালে মতির জন্য মনটা খারাপ লাগতে লাগল। উঠে গিয়ে ছাতাটা খুঁজলেন, পেলেন না। ওরা নিয়ে গেছে হয়ত। জানলার ধারে দাঁড়ালেন, রতনের খাটালটা খুব দূরে নয়, যদিও জানলা দিয়ে দেখা যায় না, তবুও যদি গরুটা এদিক দিয়ে বাড়ি ফেরে। ভাবতে ভাবতে সত্যিই মোড়ের মাথায় গরুটাকে দেখা গেল। তার দিকে এগিয়ে আসছে ধীরে ধীরে। রাস্তায় তেমন একটা লোক নেই। গরুটা তার জানলার কাছে এসে দাঁড়ালো। তার দিকে তাকালো। জিভটা বার করে চেটে দিল তার দুটো গালই। গরুটা বৃষ্টিতে ভিজছে। হঠাৎ গরুটা জোরে জোরে মাথা নাড়তে লাগল, সাথে তার গলার ঘন্টাটাও দুলতে লাগল...কিন্তু আওয়াজটা এত চেনা...চমক লাগল পরাশরবাবুর কলিংবেল বাজছে। আবার ঘুমিয়ে পড়েছিলেন? 
        রতন ঘোষ এসেছে, “দাদা একটু কথা আছে।”
        রতন ভিজে ছাতাটা দরজার এক কোনায় রাখল। পরাশর ছাতাটা দেখল। মনটা খারাপ হল। রতন মাটিতে বসল, ও চেয়ারে বসে না। বলল, দাদা আমি ভাবছি একটু কৈলাস মানসসরোবরটা দেখে আসি। আমার শালা ওদিকে একটা কাজ পেয়েছে, থাকবে কয়েক মাস, তা বারবার আমাদের বলছে যেতে... আপনি যদি একটু আমাদের টিকিটটা কেটে দেন কম্পিউটারে, বড়ালের দোকান তো বন্ধ। 
        পরাশর বলল, গরুগুলো? বলেই ভাবল, বোকা বোকা প্রশ্ন করা হল, রতনের ভাই কবুতর তো আছেই, সেই দেখবে। পরাশর বলল, হুম ওদের নিয়ে তো আর পাহাড়ে যাওয়া যায় না! 
        রতন হেসে বলল, সেরকম কথা কোন গরু স্বপ্নেও ভাববেন বলুন...

[ছবি - Suman Das]