ঝুলবারান্দায় গীতবিতান রাখা। টেবিলে। রাখা, না সাজানো?
হাওড়া থেকে যত ট্রেন যতদিকে যায়, যাওয়া হল তো মোটামুটি। পাহাড়, নদী, সমুদ্র, জঙ্গল, ঐতিহাসিক শহর, অত্যাধুনিক শহর। এবার? মন তো সমুদ্রের বালির মত। কিছু দাঁড় করিয়ে রাখল না। স্মৃতিগুলো মৃত ঝিনুকের মত, অনুভবহীন, শীতল।
মোবাইলের মাধ্যমে যারা কথা বলে, তারা তো অভিধানের মত, শুরুর শব্দ থেকে শেষ শব্দ জানা। কি বলবে, কি শুনবে? দেখা করতে আসার লোক প্রায় নেই। কাজের মানুষ আছে, দু’জন। একজন রান্না করে, আরেকজন বাকি কাচাকাচি, ঝাঁটান্যাতা ইত্যাদি করে চলে যায়।
এখানে বসলে ট্রেন দেখা যায়। লোকাল ট্রেন, শিয়ালদা মেন লাইন। এদিকে নৈহাটি, ওদিকে কাঁকিনাড়া।
চা ঠাণ্ডা। জ্বর গায়ে। প্রচণ্ড ব্যথা গা হাত পা। উঠতে ইচ্ছা নেই। সামনে বাপন সব্জী নিয়ে যাচ্ছে ভ্যানে, তার দিকে তাকাচ্ছে…
কেমন আছিস রে?
জ্বর কমেছে মাসিমা?
না রে। ভোগাবে। তুই কি বাড়ি যাচ্ছিস?
হ্যাঁ গো… লাগবে কিছু?
না রে রান্নার মেয়েটা কিনে এনেছে… আমার নামার ক্ষমতাও নেই আর।
বাপন ভ্যান নিয়ে দাঁড়ালো। ওর কি উপরে আসতে ইচ্ছা করছে? কিন্তু আসা যায় না। বাসন্তীরও ইচ্ছা করছে না সমাজের শ্যাওলা ধরা ক'টা ইট সরিয়ে ডাকে ঘরে। কি মায়াবী চোখদুটো ছেলেটার। যেন কেঁদেছে অনেক। কাঁদলে কিছু বোঝা যায়?
বাপন দাঁড়িয়ে, কি বলছে যেন….
…আমি দু’দিন আসব না মাসিমা…. ক্যানিং যাব… ঘুরতে… আমার শ্বশুরবাড়ি…. তোমার কিছু লাগলে কাল যাওয়ার আগে দিয়ে যাব?
বাসন্তী, ক্যানিং শুনে সুন্দরবনের কথা ভাবছে। স্কুলে পড়াতে গিয়েছিল মনে আছে। এখন সব শুধু স্মৃতি।
না রে… লাগবে না…. তুই সুন্দরবন গেছিস?
না গো… সময় হয় না… আমার মেয়েটার আবার ভয় বেশি… বলে বাঘে খাবে নাকি ওকে…
রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে কয়েকজন তাকাচ্ছে। আজ যদি তার বয়েস বাপনের মত হত? চোখের মধ্যে তীর থাকত। ছুঁড়ে দিত। আজ তাচ্ছিল্য। কিম্বা একটা বোকা বোকা অবাক হওয়া হাবভাব। বাপনের চেহারাটা খুব সুন্দর। ঘেমে সারা গা। পুরুষ শরীরের ঘামের গন্ধ…. কি যেন থাকে একটা… যাদু…. কি থাকে?
চেয়ারে যেন কয়েক দাগ ঢুকে গেল বাসন্তী। মনের ছটফটানি দেখছে। ইচ্ছা করছে বাপন আসুক। তার ড্রয়িংরুমে বসুক। ঘামের গন্ধে ঘরটা ভরে যাক। সব পর্দা টানা থাক। চোখ জাল ছড়িয়ে বসুক। নাকের পাটা, হাতের পেশীর ভাঁজ, কাঁধের ওঠাপড়া, থাইয়ের চঞ্চলতা… সব একে একে ধরা পড়ুক জালে।
বাপন মেয়ের গল্প করছে।
হঠাৎ বলল বাসন্তী, বাপন উপরে আসবে? চা খাবে?
একি করছে! ঘাম ব্লাউজ ভিজিয়ে বগল থেকে পেটের উপর বেয়ে নামছে। হাতটা ঠাণ্ডা। কখন দাঁড়িয়েছে নিজে, ঝুলবারান্দার রেলিং ধরে? কেন ডাকছে? বাপন আসছে। বুকের ভিতরটা ধড়াস ধড়াস করছে। ছোটোবেলাটা কেন মনে পড়ছে? কেন একটা গোপন অপরাধবোধকে নিয়ে আবার বাঁচতে ইচ্ছা করছে? কি চাইছে? শরীর? শরীর কি শুধু শরীর দিয়ে তৈরি? প্রতিটা পেশীতে কি ইচ্ছা জড়িয়ে থাকে না? ইচ্ছা নিয়েই তো শরীর… নইলে তো সব মৃত… সব।
কান গরম হয়ে আছে। মাথার পিছন দিকটা দবদব করছে। ইচ্ছা করে দরজার কাছে যেতে গিয়ে সোফাটা ঘুরে আয়নার দিক হয়ে পা গেল। দেখল নিজেকে। কে সে? সামাজিক প্রথা? না ইচ্ছা? আসুক না বাপন।
কলিংবেল বাজল।
কুলকুল করে ঘেমে যাচ্ছে সে। যেন ঘাম হয়ে গলে সবটা শেষ হয়ে যাবে সে। ফুরিয়ে যাবে।
বাপন দাঁড়িয়ে দরজার বাইরে। বলল, কি বলছিলে মাসি মা?
থতমত খেয়ে গেল বাসন্তী। মাথাটা ঘুরে গেল। দরজাটা ধরে বলল, একটু দাঁড়া….
ঘর থেকে একটা পাঁচশো টাকার নোট এনে বাপনের হাতে দিয়ে বলল, মেয়েটাকে কিছু কিনে দিস না রে… আমার কিছু দেওয়া হয় না….
বাপন হাঁ করে তাকালো। টাকাটা দেখল। ঝুঁকে এলো পায়ের কাছে। প্রণাম করল। তার ঘামের গন্ধ সারাটা শরীর অসাড় করে দিল। তার প্যাণ্টের থেকে সামান্য বেরিয়ে জাঙ্গিয়ার ইলাস্টিক, দেখা যাচ্ছে। চশমা পরে নেই, নইলে দেখতে পেত কোন ব্র্যান্ড…. বুকের ভিতর কে যেন বলছে এই এই… কে যেন বলছে আর না, আর না… কে যেন বলছে ছি ছি…. কত বাসন্তী বুকে?......
সোফায় এসে বসল। বাপন চলে গেছে এতক্ষণে। রাস্তাটা ফাঁকা। শূন্য। গীতবিতান বাইরে পড়ে। ঝুলবারান্দায়। থাক। ইচ্ছা করছে না ঘরে আনতে আজ।