১
===
ঘুড়িতে চড়িয়ে পিঁপড়ে ওড়ায়। কিন্তু সে পিঁপড়েরা কি ফেরে? ফেরে না তো! আকাশে মিলিয়ে যায়? তাই কি হয়? মাটিতেও তো পড়ে না। তবে?
এ কথাটা বাবা, মা, ঠাকুরদা, ঠাকুমা কাকে না জিজ্ঞাসা করছে খোকন। কিন্তু কেউ ভালো করে প্রশ্নটা শোনেই না। আগেই বলে দেয়, ও বাতাসে উড়ে যায়... আকাশে মিলিয়ে যায়... মাটিতে পড়ে যায়….
একটা উত্তরও মনের মত হয় না। বিকালে আবার মাঠে যায়। আবার ঘুড়িতে পিঁপড়ে চড়ায়। আবার হারিয়ে যায়।
একদিন খোকন ঠিক করল পিঁপড়ে না, ওই লাল কেন্নোটাকে চড়াবে। লাল কেন্নোটার কত্ত পা রে বাবা! একটা কাঠিতে বসিয়ে, ঘুড়ির উপরে তুলে, দিল উড়িয়ে। ঘুড়িটা উড়ছে ওই অত উঁচুতে। মনে হচ্ছে যেন কেন্নোটাকেও দেখা যাচ্ছে। একটা প্লেন আসছিল এইদিকে, পাইলট ঘুড়ির উপর কেন্নো দেখেই প্লেনের মুখটা দিল ঘুরিয়ে। নইলে কেন্নোটা ধাক্কা লেগে মরে যেত না!
প্রায় দু'ঘন্টা ঘুড়ি উড়িয়ে যখন ঘুড়িটা নামাচ্ছে তখন বুকটা দুরুদুরু করছে খোকনের। যদি কেন্নোটা না থাকে! যদি অত উঁচুতে উঠে ভয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়ে থাকে। নাহ্... এই তো কেন্নোটা। ঘুড়িটা মাটিতে নামতেই সে টুক্ করে নেমে গুটিগুটি হাজার পায়ে চলে গেল। খোকনও পুকুরে হাত-মুখ ধুয়ে বাড়ি চলে এলো। সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। পড়তে বসতে হবে। কিন্তু আজ তার মনটা ভীষণ খুশি। কি দারুণ কেন্নোটা উড়ে আবার নেমে এলো মাটিতে। কেন্নোটার কেমন লাগছিল আকাশে? এই সব ভাবতে ভাবতে বইয়ের পাতাটাই যেন আকাশ হয়ে গেল, আর অক্ষরগুলো ঘুড়ি আর কেন্নো। এমনকি শুতে গিয়ে ঘুমের মধ্যেও একই স্বপ্ন দেখল খোকন, ঘুড়ি আর কেন্নোর।
পরের দিন বিকালে আবার মাঠে গেছে। মাঠটা ভিজে। সকাল থেকে বৃষ্টি হয়েছে খুব। কিন্তু কেন্নো কোথায়? চারদিকে তাকিয়ে ভাবছে খোকন, এমন সময় সে যা দেখল তা নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারল না। প্রায় পাঁচশো, ছশো কেন্নো সার দিয়ে তার দিকে এগিয়ে আসছে। খোকন একবার ভাবল পালিয়ে যায়। কিন্তু ঠাম্মি বলে বিপদে যে পালিয়ে যায় সে আসলে কাপুরুষ। মানে ভীতু। কিন্তু ভীতু তো খোকন না। তাই সে পালালো না। অপেক্ষা করতে লাগল। কিন্তু এত ধীরে ধীরে আসছে ওরা। এতগুলো পা, কি যে করে!
সব কেন্নোগুলো এসে তার পায়ের কাছে জড়ো হল। কিছু কি বলছে?
খোকন ভিজে মাটিতেই শুয়ে কান পাতল একটা কেন্নোর সামনে গিয়ে। কেন্নো বলল, আমি না, উনি…. উনি কিছু বলবেন।
খোকন মাথা ঘুরিয়ে চারদিকে চোখ বোলালো। সবাইকেই তো একইরকম দেখতে। কে যে 'উনি' বুঝবে কি করে?
হঠাৎ বাঁ-হাতে সুড়সুড়ি লাগতে খোকন তাকিয়ে দেখে একটা কেন্নো তার হাত বেয়ে উঠে আসছে। খোকনের খুব সুড়সুড়ি লাগতেও চুপ করে সহ্য করল। আসুক, কি বলে দেখা যাক।
কেন্নোটা তার কানের কাছে এসে বলল, আরে আমায় চিনতে পারছ না? আমায় তো তুমি কাল ওই কাগজের প্লেটে চড়িয়ে ঘুরিয়ে আনলে। মনে নেই? তো কাল হল কি, বাড়ি ফিরে তো আমার কি মাথা ঘোরা! সারাদিন যা খেয়েছি সব প্রায় বেরিয়ে যায়। এমন সময় আমার গিন্নী হালকা লিকার চা নিয়ে এসে পাশে বসে বলল, তোমার কি প্রেশার বেড়েছে?
আমি তখন তাকে সব ঘটনা খুলে বললাম। বলতে বলতে চা খেলাম। চা খেতে খেতে ঘুমিয়ে পড়লাম। তারপর ঘুম ভেঙে গেল খুব চেঁচামেচিতে। জানলা দিয়ে উঁকি মেরে দেখি কি আমাদের গ্রামের সব কেন্নো জড়ো হয়ে হল্লা করছে। আসলে বুঝলে কিনা, আমার গিন্নীর পেটে তো কথা থাকে না। সবাইকে রাষ্ট্র করেছে। আমি যত বলি, ওরে খুব গা গুলায়... তারা কেউ শুনল না। ওরা বলল ওরা নাকি সকালবেলায় সবাই অ্যাভোমিন খেয়ে বসে আছে। গা কারোর গুলাবে না। তাই আর কি… তা তোমার ওই প্লেটে কতজনকে চড়ানো যাবে বাবা?
এইবার তো খোকনের বুদ্ধি গুড়ুম হয়ে গেছে। এত কেন্নোকে সে কখন চড়াবে? একটা ঘুড়িতে চারজন কেন্নোকে চড়ালেই তো ঘুড়ি আর উড়বে না। তবে?
খোকন বলল, বেশ, আমার এই ঘুড়ি তো ছোটো ঘুড়ি। আমি দেখি শহরে গিয়ে বড় ঘুড়ি নিয়ে আসি তারপর সবাইকে চড়াবো।
সবাই একসঙ্গে বলে উঠল, হুর রে….
একটা কেন্নো বলল, আসলে দাদাভাই আমরা তো কেউ তালগাছের বেশি উঁচুতে চড়িনি। তাই বারবার বলছিলাম যদি আমাদের একটু উঁচুতে আকাশ দেখিয়ে আনো। তুমি বড় ঘুড়ি নিয়ে এসো, আমরা ওই বটগাছের বাঁদিকের ঝোপের মধ্যে থাকি, খুব সাবধানে পা ফেলে ফেলে এসো... আমরা অপেক্ষা করব।
২
===
খোকন শহরে গিয়ে সত্যিই পেল্লায় ঘুড়ি কিনে আনল। ঠাম্মির সঙ্গেই গেল। অন্য কাউকে বললে হাজার একটা প্রশ্ন করত। সকালবেলাতেই মাঠে এল। ঝোপের দিকে সাবধানে পা ফেলে ফেলে গেল। বলল, আজ বিকালে আমি ঘুড়ি নিয়ে আসব। তোমরা সব এসো কেমন!
ঝোপের ভিতর থেকে আওয়াজ এলো…., আচ্ছা….
বিকালে বড় ঘুড়ি নিয়ে যখন মাঠে এলো তখন সারা মাঠ কেন্নো থিকথিক করছে। খোকন কাছে গিয়ে ঘুড়িটা যেই না পেতেছে, অমনি ঘুড়ির উপর কোত্থেকে একটা কোলাব্যাঙ লাফিয়ে পড়ে বলল, আগে আমি, পরে ওরা। নইলে সবক'টাকে খেয়ে ফেলব লাল চাটনি করে বলে দিলুম।
খোকন পড়ল ভীষণ সমস্যায়। একটা ব্যাঙ নিয়ে কি করে ঘুড়ি ওড়াবে! সে ব্যাঙটাকে 'বাবা বাছা' করে কত বোঝালো। ও কিচ্ছু শুনবে না। নড়বেই না। এদিকে কেন্নোগুলো তো ভয়ে আসছেই না, পাছে খেয়ে ফেলে! সবাই বসে। কেন্নোদের বাচ্চাগুলো গাঁইগুঁই করছে। খোকন একবার ওদের দিকে তাকায়, একবার ব্যাঙের দিকে তাকায়। হঠাৎ একটা বুদ্ধি খেলে গেল।
সে ব্যাঙকে বলল, ভাই…. আমি বরং একটা গ্যাসবেলুন নিয়ে আসব শহর থেকে কাল। সেই গ্যাস বেলুনে তোমায় চড়াব?
ব্যাঙটা একটু ভাবল। তারপর বলল, যদি না আনো কাল, আমি তোমার জানলায় বসে সারারাত চিল্লাবো কিন্তু। তুমি ঘুমাতে পারবে না দেখো।
খোকন বলল, আরে না না, আমি অবশ্যই কাল আনব গ্যাস বেলুন।
ব্যাঙ চলে গেল। তারপর একে একে সব কেন্নোকেই খোকন ঘুড়িতে চড়িয়ে নিয়ে এলো। কি যে খুশি ওরা হল।
পরের দিন আবার ঠাম্মিকে নিয়ে শহর থেকে গ্যাস বেলুন নিয়ে এলো। বিকালে মাঠে গিয়ে দেখে, দুটো ব্যাঙ বসে। একটা কালকের কোলা, তার পাশে বসে একটা সোনাব্যাঙ। কোলা ব্যাঙটা বলল, আমার মাসির মেয়ে এসেছে কাল, তাই ওকেও নিয়ে এলুম।
খোকন বলল, আচ্ছা।
যেই না ব্যাঙদুটো গ্যাস বেলুনে বাঁধা প্লাস্টিকের পাটাতনে চড়তে যাবে, অমনি কোত্থেকে একটা ষাঁড় এসে বলল, বাহ রে! আমার যেন আকাশ দেখতে ইচ্ছা করে না? আমি কেবল মাথা নীচু করে ঘাসই খেয়ে যাব চিরটাকাল?
খোকন এইবার গেল ঘাবড়ে। এদিকে ষাঁড় ব্যাঙদুটোর কাছে গিয়ে বলল, যদি আমায় না নিয়ে চড়েছিস, এমন গুঁতোবো না যে একদম কৈলাসে গিয়ে পড়বি।
এদিকে খোকন মনে মনে ভাবছে যে এই এতবড় ষাঁড়টাকে চড়ানোর মত গ্যাস বেলুন সে কোথায় পাবে?
হঠাৎ কালো মেঘ করে এলো আকাশ ছেয়ে। কালবৈশাখীর ঝড় শুরু হল। দেখতে দেখতে ব্যাঙদুটোকে নিয়ে সাঁ করে আকাশে উড়ে গেল বেলুন। এক ঝটকায় একটা কালো মেঘ এসে ষাঁড়টাকেও চ্যাংদোলা করে উড়িয়ে নিয়ে গেল হুস্ করে। খোকন ভাবছে, কি হচ্ছে এই সব!!!…. এইবার কি তাকেও….
হঠাৎ শুনল মায়ের গলা….,
খোকন ওঠ শিগগিরি, ঝড় উঠেছে... মাথার দিকের জানলাটা বন্ধ কর... পুরো বিছানাটা ধুলো ধুলো হয়ে গেল... কালকেই চাদরটা কেচেছি…
খোকন ধড়মড় করে উঠে কি হচ্ছে বুঝতে না পেরে জানলাটা বন্ধ করতে যাবে..., দেখে আকাশে একটা বড় ষাঁড়ের মত মেঘ তার দিকে ধেয়ে আসছে…. খোকন 'ধড়াম' করে জানলাটা বন্ধ করে দিয়ে বাঁচল….