ঘৃণা কোনো নীতি নয়। একটা স্বাভাবিক মানসিক প্রতিক্রিয়া। যেমন খিদে, তেষ্টা ইত্যাদি। এই স্বাভাবিক প্রবৃত্তিগুলোকে সংযত করে বিবেচনা বুদ্ধিতে প্রতিষ্ঠ হওয়াটা কঠিন কাজ। জঙ্গল থেকে সভ্যতার দিকে আসাটা যে কারণে অবশ্যই কঠিন কাজ। রবীন্দ্রনাথের "পৃথিবী" কবিতা স্মরণীয়। ঘৃণা না, বিবেচনায় প্রতিষ্ঠিত হওয়া বলিষ্ঠ মানসিকতার পরিচয়।
ঘৃণা দুর্বল করে। আপাত ভাবে ভীষণ প্ররোচনা দিলেও, অবশেষে দুর্বল করে। যে কোনো প্ররোচনাই তাই।
ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ ক্রোধ। আমরা যত ঘৃণাকে উস্কানি দেব, তবে ক্রোধের দাবানলের রাস্তা তৈরি করব। ক্রোধ মুহূর্তে মিছিলকে "মব" এ পরিণত করে। ব্যক্তি থেকে সমাজ, সব কিছুকে তছনছ করে দিতে পারে এই ঘৃণা।
মানুষ অবশেষে বিবেচনাশক্তির উপর ভরসা রাখে বলেই কোর্ট-আইন আদালতের উদ্ভব। স্বেচ্ছাচারিতা থেকে বাঁচাবে বলেই গণতন্ত্রের উদ্ভব।
অথচ এই সোশ্যালমিডিয়ায় সব চাইতে তাড়াতাড়ি বিকোয় ঘৃণা। যাকে বর্তমানে hate speech বলে নতুন নামে দেগে দেওয়া হয়েছে। বিচার মানে প্রতিশোধ না। ঠিক তেমনই বিরোধ মানে ঘৃণা না। বিরোধ, অসহযোগ, সত্যাগ্রহ শব্দগুলো জন্মেছিল ঘৃণার মত আদিম অসংযত বিবেচনাহীন অন্ধপ্রবৃত্তি থেকে বুদ্ধিকে রক্ষা করার জন্য। সুসিদ্ধান্তকে রক্ষা করার জন্য।
আজ যত দিন যাচ্ছে আমরা বুঝছি সত্যাগ্রহ ছাড়া রাস্তা নেই। গুলিবন্দুক, গুপ্তহত্যা দিয়ে নর্থ কোরিয়ার মত "সুশীল" সমাজ বানানো যায়, সমীচীন সমাজ বানানো যায় না।
যতদিন সমাজ থাকবে, ততদিন বর্বরতা, দুর্নীতি থাকবে। অমর্ত্য সেনের বিখ্যাত বই ‘আইডিয়া অব জাস্টিস’ এ ন্যায় অর্থে কখনওই পৃথিবী দুর্নীতি শূন্য করা সম্ভব বলা হচ্ছে না, বলা হচ্ছে আশু দুর্নীতির সঙ্গে লড়াইয়ের কথা। নোম চমস্কিও বলছেন সেই সত্যাগ্রহের পথেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কথা।
সত্য ঘৃণার সহচর নয়। সত্য বিবেচনার সহচর। যা সত্যহীন আজ না হয় কাল তা ধ্বংস হবেই। এ অবশ্যই সত্য। ট্রুথ প্রিভেলস। সত্যমেব জয়তে। সত্যের সাধনায় অনেক সময়ই ছল-কপট, শর্টকাট ইত্যাদি নানা প্রলোভন আসে। অনেক অনেক প্ররোচনা আসে। যুক্তির ধারও সে পক্ষে কম থাকে না। কিন্তু সুস্থ প্রজ্ঞার স্বচ্ছ দৃষ্টি সে ছল-কপটতাকে ভেদ করে আসল বস্তুটা দেখতে পারে। খাঁটি বস্তুটা দেখতে পারে।
আমার অনুরোধের কোনো মূল্য নেই জানি। তবু একান্ত প্রার্থনা, ঘৃণাকে, উস্কানিকে ছড়াবেন না। আপনি হয় তো অনেক লাইক, বাহবা পাবেন। হয় তো ক্ষণিকের জন্য আপনার জ্বালা জুড়াবে। কিন্তু তার সাইড এফেক্ট কী কী হতে পারে সে দায় কে নেবে? আমার শিক্ষাদীক্ষা, ডিগ্রী, হাইক্লাস, প্রচুর অর্থ ইত্যাদি ইত্যাদি…. সব শূন্য হয়ে যায় শুধুমাত্র বিবেচনাহীন হলে। ঘৃণা অবশ্যই স্বাভাবিক, কিন্তু কাম্য না। সে কোনোদিন কোনো সমাজকে সঠিক রাস্তা দেখায়নি, দেখাবেও না ভবিষ্যতে। নিজের আপাত অগভীর আবেগকেই সত্যর ধ্বজা ভেবে ভুল করলে। যদি সত্যহীন হয়ে পড়লাম, তবে আর কী রইল হাতে? আর যদি সত্যের দিকে থাকি, তবে গোটা বিশ্বই যদি বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, আমার কী আসে যায় তাতে?