সমাজে একটা অদৃশ্য মাপকাঠি থাকে। বাবা-মা, শিক্ষক-শিক্ষিকা, ধর্মীয় অনুশীলন, সমাজের কিছু স্থির বিশ্বাস - এরা তৈরি করে এই মাপকাঠি। সেই মাপকাঠি অনুযায়ী নিজেকে গড়ে নিতে পারার জন্য তৈরি হয় একটা অনির্দিষ্ট অপরাধবোধ। যে অপরাধবোধ অবচেতনে সারাটা জীবন থেকে যেতে পারে, গোটা জীবনকে অলক্ষ্যে প্রভাবিত করতে পারে। হীনমন্যতার শিকার হয় গোটা জীবন। সিদ্ধান্তহীনতা, লজ্জা, অপরাধবোধ - এ সবের সংমিশ্রণে অন্তর্জীবন দুর্বিষহ। তবু অভ্যাস হয়ে যায় একরকম টিকে থাকার। বেঁচে মরে থাকার।
একটা ক্লাস এইটে পড়া ছেলে, আত্মহত্যা করল, কারণ সে তার বাবা মায়ের আশানুরূপ হতে পারেনি। সবাই আত্মহত্যা করে না। বাকিরা বেঁচে মরে থাকে ভিতরে ভিতরে, এক অদ্ভুত পঙ্গুত্ব নিয়ে। তার একমাত্র উপজীব্য সহানুভূতি। অসুস্থ হলে বাবা মায়ের মনোযোগ পাওয়া যায়। তাই অসুস্থ হও। অসুস্থ হওয়ার ভান করো। নিজের দুঃখকে আজীবন বেচো। ওতে সহানুভূতি পাওয়া যাবে। ওতে নিজের অযোগ্যতা, অপরাধবোধের থেকে নিজের মন সরবে। দুঃখকে সামনে এনে, নিজের নানা বিষয়ে অপারগতাকে সামনে রাখো। কারণ অহংকারী মানুষ সহানুভূতি দেখাতে ভালোবাসে। সহানুভূতি যে দেখায় তার মধ্যে আত্মগর্ব অনুভব হয়। আজ আমি কাঁদছি না, আজ আমি অন্যের চোখের জল মোছাচ্ছি। এও এক অসুস্থতা। একজন দুঃখ বেচে জীবন কাটাতে চাইছে। আরেকজন সহানুভূতি বিকিয়ে নিজের অহমিকার তোষণের রাস্তা খুঁজছে। এক চক্র তৈরি হচ্ছে। অস্বাস্থ্যকর চক্র।
যে সত্যকারের সহমর্মি সে জানে না, সে সহমর্মি। যে সত্য অর্থে দুঃখী, সে জানে না সে দুঃখী। তার অভাব তাকে পীড়া দেয় না। কোনো সহমর্মির চিত্তকে দেয়। সে গোপনে তাকে সাহায্য করে। ভুলে যায়। কারণ স্বভাবজাত কাজ স্মরণে থাকে না, অহং জাত কাজ ভোলা যায় না।
এই অনির্দিষ্ট, মূক অপরাধবোধের কোনো পরিচয় নেই। সে জানে সে অযোগ্য। কারণ তার বাবা-মা বলেছে সে পাশের বাড়ির, কি আত্মীয়স্বজনের মধ্যে কোনো এক বিশেষ সফল মানুষের মত হতে পারেনি। তার ধর্ম তাকে শিখিয়েছে সে কামুক, লোভী, ভক্তিহীন, স্বার্থপর। তার সমাজ তাকে শিখিয়েছে সে পিছিয়ে পড়া। কারণ সমাজ মেধার তালিকায় চলে, সে তালিকায় তোমার জায়গা কোথায়? ওই দেখো তলানিতে। তুমি নামো। আরো নীচে নামো। তোমার মধ্যে যে অন্ধকার তৈরি করে দিয়েছি সেই অন্ধকারের নাম্বার বলো। সমাজের সফল লোকেরা তোমাকে সহানুভূতি দেখাবে, তুমি তরে যাবে।
কারণ সমাজটা প্রিভিলেজডদের। প্রাইমারী স্কুল থেকে শুরু করে চাকরি পরীক্ষায় ট্রেনিং দেওয়ার প্রতিষ্ঠান অবধি, স্বাস্থ্য থেকে ধর্মীয় গুরুদের প্রতিষ্ঠান অবধি সব অতি অর্থবানদের দখলে। তুমি লড়বে তো কত লড়বে? তোমার যত টাকা ঢালার ক্ষমতা, তত তোমার উন্নত প্রাথমিক শিক্ষা থেকে শুরু করে বড় গুরু ধরার ক্ষমতা। নীচে থেকেও তুমি কি বিশেষ মেধা সম্পন্ন মানুষ? সে তো প্রকৃতির ভারসাম্য রাখার কৌশল। সবটা মানুষের হাতে থাকে না। সেখানে তো তুমি উদাহরণ, তুমি কত নীচে থেকে উঠে এসে এই প্রিভিলেজ ক্লাসে জায়গা করেছ, সেখানে তো তুমি বিক্রিযোগ্য গল্প। মুখরোচক গল্প। তুমি প্লাটফর্মে এসে দাঁড়াও। তোমার গল্প বলো। আমি অন্ধকারে চেয়ারে বসে শুনি। তোমার উপর আলোর ফোকাস। আজ তুমি জয়ী। তোমার গল্প শুনে আমি আমার একঘেয়ে জীবনের স্বাদ একটু বদল করি। মানুষ নিজের ধারণা না বদলে অন্যের ধারণার গল্প শুনতে ভালোবাসে। ওতে সুখ হয়। অ্যাম্বিশানের সুখ। তোমার উচ্চকাঙ্ক্ষার গল্পের মধ্যে আমার উচ্চাকাঙ্ক্ষার প্রশ্রয়। বলো বলো, আরো গল্প বলো। আমি আইডিয়া ট্যুর করি। মানুষ আইডিয়া ট্যুরিজিমে যায়। ভীষণ ভায়োলেন্ট মানুষ, ঠাণ্ডা ঘরে, নিরালায় বসে অহিংসার আইডিয়া নিয়ে খেলে। ভীষণ লোভী মানুষ, আশ্রমে গিয়ে ত্যাগের আইডিয়া নাড়াচাড়া করে। ওতে সুখ। নিজের ইমেজের নানা খোলস। বদলে বদলে সুখ। আসলে আমি কি সে তো আমিই জানি। একে হিপোক্রেসি বলে না, একে বলে ভাবনার দ্বৈরথ। আমরা সবাই রথে।
কিন্তু ক'টা মানুষ আর নিজেকে ব্যতিক্রমী, মিশাল, উদাহরণ বানাতে পারে। বাকিরা? অন্ধকারের বালিশে মুখ গুঁজে। তাকে কেউ ছোটোবেলা থেকে খোঁজেনি। না বাবা-মা, না সমাজ, না ধর্ম। সবার পরশপাথরের যোগ থাকে না, যে বলে দেয় তোমার মধ্যে এইদিকটা বলবান, তুমি এটা নিয়ে এগোও। ভীতু মানুষ জটিল হয়, নিষ্ঠুর হয়, কুসংস্কারী হয়। বাবা-মা, সমাজ, ধর্ম --- ভয়ে ভয়ে বেঁচে। একটু ফর্মুলার এদিক ওদিক হলে অস্তিত্ব সংকট। যার ভালোবাসা নেই তার অস্তিত্ব সব সময় সংকটে। কারণ সে মূল থেকে বিচ্ছিন্ন। সমুদ্রের বাইরে এক বিন্দু জলকণা এসে পড়লে যেমন সে মুহূর্তে শুকিয়ে যায়, সে যতই ব্রত-উপবাস করুক, যতই নেতামন্ত্রী ধরুক, তেমনই ভালোবাসা থেকে বিচ্ছিন্ন মানুষ একা, ভীতু। সে মূল থেকে বিচ্ছিন্ন। সে নিজের ভিতরে ব্যর্থ। সমাজে সফল। নিজেকে নিয়ে ব্যর্থ। কেন ব্যর্থ জানে না। গভীরে বিষাদ। এত বিষাদ, এত ভয় যে সে নিজের চোখে চোখ রাখতেই সাহস পায় না আর। নিজের ভিতরে নিজেকে মুখোশ পরিয়ে রাখে। সত্য কর্নিয়া ফাটা চোখের কাছে প্রাণান্তকর, জ্বালাময়ী, বিষ। রোদ চশমা লাগে তাকাতে। কিন্তু শিশুর মত আত্মার কাছে সত্য উজ্জ্বল, সঞ্জীবনী। সে মানুষ কই?
সমাজ ভীতু, একমুঠো অস্তিত্বরক্ষার জন্য কুকুরের মত লড়াই করা মানুষের আজ। তারা পরবর্তী প্রজন্মকে কি দেবে, সাহস? কোথা থেকে দেবে? যে মানুষ নিজে অথেন্টিক নয়, যে মানুষ নিজে জেনুইন না, খাঁটি না, সে সাহস কোথা থেকে দেবে? সে সাহসের ভান করতে পারে। গলাবাজি করতে পারে, ষড়যন্ত্র করতে পারে, একটা সংবেদনশীল বাচ্চার সংবেদনশীলতাকে হত্যা করতে পারে, সে সত্যের সঞ্জীবনী কোথা থেকে পাবে? আরে যে নিজের চোখের দিকে নিজে স্পষ্ট তাকাতে ভয় পায়, সে একটা শিশুর সরল চোখের দিকে কি করে তাকাবে? যতক্ষণ না তাকে সে বিষাক্ত ভীরু দুর্বল করে তুলছে, ততক্ষণ তো সে তাকে ‘মানুষ’ ই করতে পারছে না।
আরো আরো শিশু, তরুণের আত্মহত্যার সাক্ষী আমাদের হতে হবে। যতক্ষণ না আমরা সবল হব মানুষ হিসাবে। আমাদের বুদ্ধিজীবীতা যতক্ষণ না মানবিতার পায়ে নিজেকে বলি দিচ্ছে ততক্ষণ আমাদের এ আকাশ বাতাস এরকমই বিষাক্ত থাকবে। মানুষের গোটা চেতনাকে, সমগ্র চেতনাকে আহ্বান জানানোর সাহস, শিক্ষা যতদিন না আমরা পাচ্ছি, ততদিন এই একখণ্ড বুদ্ধিবৃত্তি আমাদের প্রাণের রস শুষে নেবে। রবীন্দ্রনাথ পথ করে দেখিয়ে গিয়েছিলেন কিভাবে মানুষের গোটা চেতনাকে মানুষের জীবনের প্রাঙ্গণে আহ্বান জানাতে হয়। আমরা শিখিনি। আমরা দেখেও দেখিনি। আমরা শুনেও শুনিনি। মানুষটাকে ক্রুশবিদ্ধ করেছি। আজ সেই ক্রুশের রক্তে ঘরদোর সাজাচ্ছি। রবীন্দ্রনাথকে আমরা মশাল করিনি, আমাদের কিছু দুর্বল সেন্টিমেন্টের গায়ে বোলানো পালক করেছি। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। আমরা সমাজ এমন বানিয়েছি, যেখানে প্রতিদিন শিশুদের আত্মহত্যার সাক্ষী হচ্ছি। এই দুর্বলতা, প্রতিহিংসাপরায়ণতা, হীনবুদ্ধি নিয়ে আমরা সুশীল সভ্য সমাজ গড়ার শখ রাখছি। পাচ্ছিও হাতে, ঘোড়ার ডিম।