ঘোরানো সিঁড়ি উপরের দিকে উঠে গেছে। বাড়ির বাইরের উঠান থেকে সরাসরি চলে যাওয়া যায় দোতলায়, বাড়ির ভিতর দিয়ে না গিয়েও। প্রৌঢ়া বিধবা মহিলা দোতলায়, রাস্তার দিকের জানলার কাছে দাঁড়িয়ে। আজ দোল। রাস্তার অন্য ফুটে একটা গাড়ি সারানোর গ্যারেজ। সেখানে চলছে উত্তাল দোল খেলা।
দুপুর দুটো। বিধবা মহিলা আবার জানলায়। মাঝে মাঝেই চীৎকার শোনা যাচ্ছে - অসভ্য, ইতর, ছোটোলোক... কোনো লাজলজ্জা নেই!... অমন খালি গায়ে... মাগো!…
তখন রাস্তার ওদিকে মাতাল দোলখেলা। হাফপ্যাণ্ট পরা, অর্ধনগ্ন পাঁচ-ছ'জন পুরুষ। মদ্যপ সক্কলে। চলছে উদ্দাম নাচ। অশ্লীল অঙ্গভঙ্গী। হিন্দী গান বাজছে উঁচু উঁচু দুটো বক্সে। তার আওয়াজে এই দোতলা বাড়ির জানলার কাঁচগুলোও কেঁপে উঠছে ঝনঝন করে। চমকে চমকে উঠছে বাড়ির ঘুলঘুলিতে থাকা পায়রাগুলো।
"দিদি স্নান করতে যাবেন না?" বিধবা মহিলাকে জিজ্ঞাসা করলেন এক সধবা মহিলা। ওনার জা। বছর দশেকের ছোটো। "কি অসভ্যতা করছে দ্যাখ ওগুলো...", ছোটো জা জানলার দিকে একবার উঁকি দিয়ে বড় জায়ের চোখের দিকে তাকালো। দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হল। বড় জা চোখ সরিয়ে বলল, "চললাম স্নানে।" ছোটো জা বলল, "জানলাটা বন্ধ করে দিই?" উত্তর এলো না। বাথরুমের দরজা বন্ধের আওয়াজ এলো - দড়াম!
স্নানে গেলেন। পায়ের আবীর আগেই তোলা হয়ে গিয়েছিল। ভেবেছিলেন মাথায় শ্যাম্পু করবেন। থাক আজ। মাইকের আওয়াজটা বুকের মধ্যে হাপর পেটাচ্ছে। কি অসভ্য রে বাবা! ওভাবে ল্যাংটো হয়ে নাচতে লজ্জা লাগে না! তাও আবার রাস্তার ধারে? বাড়িতে বউ-বাচ্চা নেই?
'বাচ্চা' কথাটা মনে মনে উচ্চারণ করলেও, ঠেক খেলেন। মেয়েটার খোঁজ নেওয়া হয়নি এক সপ্তাহ হল। ওনার মেয়ে, বিয়ে হয়েছে বিলাসপুর। মেয়ের সাথে আগের মত নৈকট্য অনুভব করেন না। আসলে কারোর সাথেই আর সেরকম নৈকট্য অনুভব করতে পারেন না। একা একাই থাকেন, নিজেকে গুটিয়ে নিজের ভিতরে। সংসারে তার পরিচয় আর নিজের কাছে নিজের পরিচয়ের মধ্যে বাড়ছে বিস্তর ফারাক। কারণ খুঁজতে যান না। অন্তর্বাসের মত একাকীত্ব ঘিরে ফেলে তাকে মাঝে মাঝেই।
ঠাকুরঘরে ঢুকলেন। জপের সংখ্যা ভুল হচ্ছে। ১০৮ বার যেন হাজার আট মনে হচ্ছে। উফ্! কি অসহ্য মন্ত্রের জ্বালা। মাইকের আওয়াজ আসছে। হিন্দী গানটা জানেন। ছোটো জায়ের ছেলের মোবাইলে শুনেছেন। চোখ বন্ধ করলেই আবার সেই ছবি - অসহ্য নাচটা! উঠে এলেন।
বাইরে এখনও চলছে তাণ্ডব। কে যেন কার প্যান্ট টেনে খুলে দিচ্ছে! উফ্ অসহ্য... ”ছোটো!”, চীৎকার করে উঠলেন। "দে তো জানলাটা বন্ধ করে"...
ছোটো জা ঘরে এলো। বড় জা ততক্ষণে বিছানায় শুয়ে, হাতটা ভাঁজ করে চোখের উপর আড়াআড়ি রাখা। ছোটো জায়ের মুখে একরাশ তাচ্ছিল্য। সশব্দে জানলা বন্ধ হল। বড় জায়ের কপালে দেখা গেল ছোট্ট একটা ভাঁজ। মিলিয়ে গেল ক্ষণিকেই। বড় বলল, "তোরা খেয়ে নে, আমার মাইগ্রেনের ব্যাথাটা বেড়েছে।"
বন্ধ চোখ রাস্তার ওপারে, গ্যারেজে। একবার চোখ খুলে জানলাটার দিকে তাকালেন। জানলাটার পাল্লার নীচের দিকে একটা ছোটো চেরা ফাঁক। বাইরের রোদ ঢুকছে। হঠাৎ মনে হল যেন মদের আর আবীরের গন্ধও আসছে রাস্তার ওপার থেকে। মাথার মধ্যে হাতুড়ি পেটানোর মত আওয়াজ হচ্ছে যেন। আচ্ছা মাইকটা থেমে গেছে?
থেমে গেছে। ঘড়ি দেখলেন, সাড়ে তিনটে। উঠে জানলাটা খুললেন। আবীর আবীর আর আবীর। কার কি একটা রাস্তার উপর পড়ে... প্যান্ট? যা! কি ছেলেমানুষী ভাবনা। একটা ঈষৎ হাসির রেখা দেখা গেল ঠোঁটে। পরক্ষণেই মিলিয়ে গেল।
পশ্চিম আকাশের দিকে সূর্য ঢলছে। বুকের ভিতরটা হঠাৎ খালি খালি মনে হচ্ছে। ওরা কোথায় গেল? ওদের নেশা কেটে গেছে এতক্ষণে? কেউ দেখেছে তাকে... কেউ? সব ফুরালেও কি যেন একটা ফুরাচ্ছে না ভিতর থেকে। জানলার দিক থেকে সরে ঘোরানো সিঁড়ির দরজার কাছে এলেন। নীচে নেমে গেছে ঘুরে ঘুরে উঠানে। উঠান পেরিয়ে রাস্তা। রাস্তা পেরিয়ে গ্যারেজ। গ্যারেজের পাশে ওটা কি পড়ে...
একটা আওয়াজে চমক ভাঙল। তাদের বাড়ির কুকুরটা, নীচ থেকে ঘেউঘেউ করছে তার দিকে তাকিয়ে। ওনার মুখের ভাব বদলে গেল। একটা প্রচণ্ড রাগ আর বিরক্তিতে ডাকলেন, "এই মালতী (কাজের মেয়ে)....মালতী....ওটার চেন খুলেছে কে?"
নিজের গলার আওয়াজ নিজের কানেই বড্ড বেমানান বাজল। সামনে উঠানের গাছগুলোর উপর দিয়ে বসন্তের বাতাস বয়ে গেল সরসর সরসর করে। কিছুটা আবীর উড়িয়ে নিয়ে গেল। কয়েকটা ঝরাপাতা উড়তে উড়তে হল নিরুদ্দেশ। তাকে ডেকে গেল যেন আয়...আয়...আয়...
সৌরভ ভট্টাচার্য
16 March 2017