Skip to main content

দইওয়ালা বলল, রাস্তা দেখে যেও।

কাকে বলল সে জানে না। রবিবার সকালে রাণাঘাট থেকে দুই কাঁধে দুই দইয়ের ঝাঁকা নিয়ে সে আসে। ট্রেনে চেপেই আসে। পায়ে ঢাকা রাবারের জুতো। এত গরমেও? হ্যাঁ। কারণ পায়ে গুলাটি আছে। ব্যথা করে। ট্রেনে এর ওর পায়ের সঙ্গে চাপা লাগে, ধাক্কা লাগে।

তার দই কেমন? কেউ বলে ভালো, কেউ বলে বেশি দাম নেয়, কেউ বলে ক্ষীর যত ভালো দই তত ভালো না। মানুষে মানুষে মতান্তর হবেই। সে তো ভালো কথা! ধুস, ভালো কথা আর কই। এই দেখো, এই যে ফেসবুক এলো, কত মানুষের এক বিষয়ে কত মত জানতে পারার সুযোগ পাওয়া গেল, এ ভালো হল না? আগে এত এত কথা, মত কই জানতাম? কিন্তু দেখো, কোথায় আমাদের উদার হওয়ার কথা ছিল আরো, তা না, আমরা আরো বেশি ঝগড়ুটে, মেরুবাসী করে ফেলছি নিজেদের। লোকে বলে আমাদের যুগ পোস্টট্রুথের যুগ। আমার তখন ডাকঘরের অমলের মত বলতে ইচ্ছা করে, আমরা না হয় পোস্টট্রুথের জামানায় আছি, কিন্তু এটা যে পোস্টট্রুথের যুগ, এটা তো সত্য, অর্থাৎ সেই সত্যটা তো আছেই। জানছিই। সেই নিশ্চিন্তি। কিন্তু চারদিকে এত্ত কোন্দল… উফ!

আবার আতাল কথা পাড়ছি। তো সেই দইওয়ালা লকডাউনে কি ঝামেলাতেই না পড়েছিল। এত দই সে খাওয়াবে কাকে? সব তো আর রাণাঘাটের লোকে খেলে চলবে না। তখন সে মোটরভ্যান ভাড়া করে ভটভট করতে করতে দই নিয়ে আসত হালিশহর। আমি তখন লকডাউনে বন্দী। অমলের মত। আমি কল্পনা করতাম শরতের মেঘলা আকাশে সরু রাস্তা দিয়ে, ভটভট করতে করতে একটা ভ্যান আসছে। তাতে সার দিয়ে রাখা দইয়ের ভাঁড়, ঘিয়ের প্লাস্টিকের কৌটো, ক্ষীরের ভাঁড় দুলতে দুলতে, কাঁপতে কাঁপতে আসছে। আর দইওয়ালা পায়ে গুলাটি, হরিনাম গাইতে গাইতে প্রাণের গভীরে আশ্বাসের মাধুর্যে ডুবছে। এ কল্পনা না, আমি দেখেছি যখন সে বসে থাকে বারান্দায়, গুনগুন করে গান গায়। হরিনাম গায়। "হরি হরয়ে নমো কৃষ্ণ যাদবায় নমো, যাদবায় মাধবায় কেশবায় নমো।"

একবার খুব বৃষ্টি, সে বারান্দায় বসে আনমনে গাইছে। আমি হুট করে চলে যেতে আমার দিকে সলজ্জ তাকিয়ে বলল, খুব বৃষ্টি দাদা, যেতে পারছি না, তাই বসে আছি…

আমি বললাম, কি গাইছিলে যে….

সে আরো লজ্জা পেয়ে বলল, ওই একটু হরিকে ডাকছিলাম… সংসারে আর কি আছে দাদা….

সত্যিই যদি সে জানতো। একটু বেশিক্ষণ বারান্দায় বসে গান গাইছিল, তাও হরিনাম, তাতেই তার লজ্জা, এক তথাকথিত পড়াশোনা না জানা মানুষের, আর কত পড়াশোনা করা মানুষ নিরীহ মানুষগুলোর লক্ষ লক্ষ টাকা গায়েব করে কি নির্লজ্জের মত মাথা উঁচু করে ঘুরে বেড়াচ্ছে! কি যে শিক্ষা আর কি যে অশিক্ষা এ হিসাব ভাবতে গেলে ধাঁধা।

আবার আতাল কথা বলছি। তো লকডাউনে সে তার দইয়ের দাম বাড়ালো একটু, বলল দাদা ভ্যানের ভাড়া লাগে।

ন্যায্য কথা।

কিন্তু সংসারে ন্যায্য কথার চাইতে লাভের কথার দাম বেশি। তার কিছু খদ্দের কমল। সে আসা কমালো। আবার ট্রেন চালু হল, আবার তার খদ্দের বাড়ল। চারটে টাকাই বা কেন দেবে লোকে? হোক তোমার ভ্যানের ভাড়া, আমি তা কেন দেখব? তুমি তো দই আনবে, এই তোমার কাজ…কিভাবে আনবে সে হিসাবও আমি করব? তফাত যাও! দূর হটো!

কিন্তু এই যে আমি লিখছি এত কথা, আমি কি তার নাম জানি? এই এখন জানলাম, জানি না। দরকার মনে হয়নি কোনোদিন। সব্জীওয়ালা, দুধওয়ালা, পেপারওয়ালা, ময়লাফেলার লোক… এই সব নামের আড়ালে আসল নামটা চাপা পড়ে যায়। এত অহংকার! আমি জানি নাম জিজ্ঞাসা করলে সে দারুণ লজ্জা পাবে। পায়ও। কি দারুণ ব্যাপার না? এমন কাজ সে করে তার নামটাই সেখানে অতিরিক্ত। সমাজ এমন নামহীন ব্যবস্থা করে দেয় বাঁচার জন্য। নামটা সেখানে লজ্জার, না বোঝা সে নিজেই বোঝে না।

শুরুতে যে কথাটা দিয়ে শুরু করলাম। আমার এক বন্ধু বাইক নিয়ে বেরোচ্ছে, আমি দইওয়ালাকে বললাম, তুমি একটু তোমার দইয়ের ঝাঁকা সরিয়ে রাখো, ও বাইকটা বার করবে।

সে ঝাঁকা সরিয়ে বসল। বন্ধু যেই বাইকটা নিয়ে রাস্তায় যখন উঠল দইওয়ালা তার দিকে তাকিয়ে বলল, রাস্তা দেখে যেও।

এটা সাবধান বাণী না। এটা শুভেচ্ছার বাণী। ভালোবাসার বাণী। নিজের নামের বোঝা না থাকলেই হয় তো এইভাবে কথা বলার সুবিধা হয়

আমার এক চিকিৎসক বন্ধুর গল্প বলি। কদিন আগের ঘটনা। বড় হোটেলে কনফারেন্স। তার সেখানে বলার আছে। কিন্তু তাকে গেটে আটকালো রক্ষী, বলল, আজকে ডেলিভারি বয়দের ঢুকতে দেওয়া বারণ। সে বলল, কিন্তু আমার যে ঢুকতেই হবে..আমার যে বলার আছে।

কিন্তু রক্ষী জানে এক এক ধরণের সাজের সঙ্গে এক এক শ্রেণীর মানুষের হিসাব কষা আছে সমাজে। তুমি কে হে? কিন্তু আমার এই উচ্চমানের ডিগ্রীধারী চিকিৎসক বন্ধুটি পোশাকের পরিচয়ের থেকে চরিত্রের পরিচয়ে বেশি আস্থা রাখে। শিক্ষা সম্পূর্ণ না হলে যা হয় আরকি? আরে সেই তোতাকাহিনীতে পড়োনি? পাখি তবু গায়? কি আশ্চর্য! হ্যাঁ তবু নাচে! কি অদ্ভুত! এত পুঁথিগত শিক্ষার পরেও? হ্যাঁ তো!

অগত্যা ফোন গেল ভিতরে। রক্ষী নিজের ভুল বুঝল। হয় তো এই ব্যতিক্রম তাকে সমাজের ক্রমের জড়ত্ব থেকে কিছুক্ষণের জন্য মুক্তিও দিল। জানি না। কিন্তু আমার সেই বন্ধুটি যেমন তেমনই রয়ে গেল।

রামকৃষ্ণদেব উপাধির ফাঁস থেকে নিজেকে বাঁচানোর কথা বলতেন। বারবার বলতেন। উপাধিরহিত হতে বলতেন। শান্তির জন্য। উপাধি হল তাপ। ডিগ্রী, অর্থ, বিত্ত ইত্যাদি উপাধি নয়। রামকৃষ্ণদেব খোলসা করে বলতেন, উপাধি কি? না, "আহা আমি কি হইচি!"... এই বোধ হল উপাধি। পুড়িয়ে দেবে। শান্তি দেবে না।

আমি আবার লকডাউনে ফিরে যাই। দইওয়ালা ফিরে যাচ্ছে রাণাঘাটে, বেশ কিছু দই বিক্রি হয়নি। ভ্যানের উপর রাখা। হয় তো মেঘলা আকাশ। কঠোর মাটির রাস্তা, কঠোর সমাজ তাকে আঘাত করেছে। হঠাৎ বৃষ্টি নামল ঝেঁপে। সে দাঁড়ালো বটগাছের তলায়। সামনে সবুজ ধানক্ষেত। সেকি লাভ-ক্ষতির হিসাব করবে? না না, এতদিন দেখে তাকে অত দুর্বল মনে হয়নি। সে পায়ের গুলাটিকে বৃষ্টির জলে মেলে ধরবে। বলবে ভেজ। চিত্তকে হরিনামে ডুবিয়ে দেবে। বলবে, ভেজ। নরম হবে। রামকৃষ্ণদেব বলতেন মানুষ পাকলে, সিদ্ধ হলে নরম হয়। নরম যে, সে ব্যথা ফিরিয়ে দেয় না। মিলিয়ে নেয়। এ ন্যায্য কথা না, লাভের কথা না, এ এক সবুজ ভালোবাসার কথা। যা ঘাস বোঝে, বৃক্ষ বোঝে না।