সৌরভ ভট্টাচার্য
13 August 2019
বড় কথা হল, সুখ। বিষাদের সুখ। সে বিষাদ যদি নিরাপত্তাহীন না করে। যেন নরম গদিতে শরীর ডুবিয়ে বিষাদের সুখে তলিয়ে যাওয়া। ঝিম ধরা শরীর। ঝিম ধরা চিন্তা। ঝিম ধরা ভালোবাসা। আদিরসের নিভৃত সঞ্চার।
উঠবে না। সুখকে শেষ অবধি ধাওয়া করবে। রেললাইনের মত সুখ দিগন্তে মিলিয়ে। ছুটতে ছুটতে সবটুকু উপভোগ করা। সুখের রেললাইনের দুপাশে বিষণ্ণতার শহর। মানুষ মানেই অবশেষে বিষণ্ণতা। বিশ্বাসঘাতকতা।
পাখি ডাকছে। শহরের পাখি। দূষণ বিধ্বস্ত ফুসফুসে ডাকছে। অভ্যাস, মানে ইন্সটিংক্ট। থামবে না। যতক্ষণ না মৃত্যু। মৃত্যু মানে বিষণ্ণতা। দীর্ঘস্থায়ী ব্ল্যাকহোলের সুখ।
বিছানা ছেড়ে উঠে মোবাইলের স্ক্রিনে টোকা, 11:12am. ফ্রিজে গতকালের খাবার। টেবিলে আধবোতল মদ। ছড়িয়েছিটিয়ে গতকালের মানুষদের নেশার কীর্তিকলাপ। সুখ। প্রচণ্ড সুখ। জীবন ডানা মেলেছে উত্তুঙ্গ সুখে। জীবন নেই। জীবন প্রতিস্থাপিত হয়েছে সুখে।
একার ফ্ল্যাট। দেওয়ালে টিকটিকি, বয়েস তিন মাস। মেঝেতে হেঁটে চলে বেড়ানো পুরুষ মানুষ, বয়েস ৩৮. হৃদয়কে থামিয়ে দিলে শরীর অনেক শরীরে সুখ পেতে শেখে। অনেক শরীরে অনেক সুখ। অনেক তৃপ্তি। অর্গাজমের খোলা বাজার।
পরিবার মানে সুখ। প্রাচীন পথ। পরিবার মানে অশক্তকে শক্ত হাতের আলিঙ্গন, চ্যারিটি বিগনস অ্যাট হোম। ফিল্যানথ্রপিক সুখ। প্রাচীন সুখ। এখন পরিবার মানে শরীর। শরীর মানে অর্গ্যাজম, সজ্জাবিলাস, আভিজাত্য, মায়াময় সুগন্ধি। ইয়ারলি হেলথ চেক-আপ। বাঁচো, বাঁচো, বাঁচো। মরণকে, রোগকে তুড়ি মেরে বাঁচো। দীর্ঘ আয়ু, দীর্ঘ সুখ। শরীর মানে সুখ, জীবন বড় প্রাচীন শব্দ, অর্গাজমহীন।
শাওয়ারের নীচে দাঁড়ানো শীতল জলে ভিজছে যৌবন তপ্ত শরীর। মাথার মধ্যে ডানা ঝাপটিয়ে সদ্য জেগেছে বাসনা পাখিরা। উড়বে। সমস্ত জগত জুড়ে খাবার খুঁজতে বেরোবে। সাফল্য এনে দেবে শরীরে সামনে। চোখ নাক কান ত্বক জিহ্বা - আস্বাদন করবে সাফল্য।
খাবারের টেবিলে অভুক্ত শরীর। খাচ্ছে। পাশে মোবাইল কথা বলছে স্নায়ুর সাথে। স্নায়ুর কোষে কোষে কিলোবাইটের পাদচারণ। একের স্নায়ুতে আরেক শরীরের অনুপ্রবেশ, আন্তর্জালতন্ত্রের সুড়ঙ্গ পথে। শরীরে শরীরে অশরীরী জড়াজড়ি। মাখামাখি। সীৎকার। যন্ত্রণার অভ্যুদয়। সুখের দরজা খোলার আওয়াজ। যে দরজা প্রাচীনপন্থীর দ্বারা ছিল রুদ্ধ। প্রাচীন নীতি, শরীর ছাপানো হৃদয়, অসুখী মানুষ, দেবতা সুখী। একালে অসুখী দেবতা, সুখী মানুষ। শরীরে বিষাদে। নিরাপত্তা ঘেরা বিষাদে।
গাড়িতে। অফিসযাত্রী। তীক্ষ্ণ মেধার অভিসার। প্রাচুর্যের পথে। 'অনেক' এর খোঁজে। আরো আরো আরো। অসীম ইচ্ছা। অসীম ভূমা। অসীম বাসনা। শরীর এখন স্কেলের মাপে নয়, অণু-পরমাণুর সুখের মাপে। হাত ধরে ছোটে বিষণ্ণতা। সুখে দোসর। স্টিয়ারিং ঘোরে মোড়ের শাসনে। গাড়ি দাঁড়ায়, ছোটে সিগন্যালের আধিপত্যে। চাকা গড়ায় মসৃণ সভ্যতার রাস্তায়। সুখ ছোটে আলোর গতিবেগের আগে। শব্দের গতিবেগে আসে বিষাদ। বজ্রধ্বনি - আমি... আমি... আমি। সুখের অগ্নুৎপাতে বিষাদের লাভা। স্থবির হৃদয়। ডিজিটাল মস্তিষ্ক।
সুখ ছড়াচ্ছে দাবানলের মত। ঈশ্বর - গুরু দাবাড়ুর কাছে শিখছে চাল। মা বসেছে অন্ধকারে। বাবা ছ্যাঁদাপোড়া হাতে গোটাচ্ছে স্বপ্নজাল। লুজার খুঁজছে ঝাঁপানোর ছাদ, গলার দড়ি, রেললাইনের মসৃণ ধাতব শীতল পথ। মৃত্যু এসে শরীর থামাবে। বিষাদ ছাড়বে সুখের হাত। মৃত্যু তো ব্ল্যাকহোল। সব থেমে আছে।
তুমি আমি সব থেমে আছি। কাউণ্ট ডাউন, টিক টিক টিক। সবাই জানে ফাটতে চলেছে। কি ফাটবে, কিসের বিস্ফোরণ? সবাই জানে। তবু কেউ জানে না। স্টিয়ারিং এ হাত, লাল সিগন্যালে দাঁড়িয়ে সুখের চাকায় বিষণ্ণতা। ঘরে ফিরবে? ঘর কোথায়?