একটা হাতপাখা হাতে নিয়ে ছাদের দিকে উঁচু করে বলল, ওই যে।
ছাদে বসে প্রজাপতি। নীল রঙ। হলুদ ছিটছিট।
“তুমি কখন থেকে দেখছ?”
হাতের পাখাটা দিয়ে বাতাস করতে করতে বলল, ভোর থেকে।
“আচ্ছা, তুমি ভোরে উঠেছ?”
না। ঘুমাইনি।
“তোমার আজকাল ঘুম হয় না?”
হয়। আবার হয় না। ওকে নিয়ে যাও.. নইলে হারিয়ে যাবে।
“কোথায় হারিয়ে যাবে? এটা তো ঘর। তুমি তো এই ঘরে এই এতগুলো বছর কাটিয়ে দিলে..কত হবে, ষাট না?”
ঘরেই তো হারায় মানুষ।
======
পাঞ্জাবির হাতাটা গুটিয়ে, মিষ্টিটা মুখে পুরে, মনটা প্রথমে জিভের স্বাদে, তারপর শব্দে এনে বলল, ঠাকুমার মাথাটা তো একেবারেই গেছে গো…কী একটা প্রজাপতি ছাদে বসে আছে সেই নিয়ে কি ভাবনা……
চশমাটা চোখ থেকে খুলে জামার খুঁটটা দিয়ে মুছে, আবার নাকে আর কানে রেখে বলল, প্রজাপতি?.
বাবার প্রশ্নে অবাক হয়ে ছেলে বলল, বাব্বা! এমন ভাব করছ….এই জঙ্গলের মধ্যে বাড়ি…বাঘ আসে না এই রক্ষে….আর প্রজাপতি… কী করে যে থাকো এখানে….
বাবার চোখদুটো মনটাকে কানের থেকে সরিয়ে নিয়ে গেছে অনেক দূর। একটা পুকুর। পাশে বসে মা। মাছ ধরছে। বলছে, আজ যদি একটা বড় মাছ ওঠে বাবু, তোর স্কুলের জামাটা হয়ে যাবে…..
বাবার মুখটা মনে পড়ত না। কিন্তু বাবার অভাবটা জ্বালাতন করত। ঘুমের সময় অন্ধকার ঘরে ঢুকে পড়া জোনাকির মত। ঘুমাতে দেয় না, আবার ঘুম না আসার কষ্টটাও মধুর করে রাখে। মা মাছ ধরছে। ওপারে সূর্যাস্ত হচ্ছে। আজান পড়ছে মাইকে। মা বলছে বাবু, আজ তুই সন্ধ্যে দিয়ে দিস, আমি মাসির ওখান থেকে ঘুরে আসব। আজ ওদের বাড়ি সত্যনারায়ণ পুজো।
ছেলে নেই সামনে। বাইকটায় স্টার্ট দিয়েছে। তার মানে ‘'বাবা আসছি” বলেছে। শোনেনি। নাকি শুনতে চায়নি।
=====
মা, তোমার ঘরে নাকি প্রজাপতি এসেছে?
আপনি ঘরের বাইরে যান। আমার এখনও আহ্নিক হয়নি। ছেলে কলকাতা থেকে এলে আপনার সঙ্গে কথা হবে। জমির কাগজ ওর কাছে। আমার কাছে নেই বললাম তো।
মা, আমি…আমি…
শুনুন, আপনার আগে আরেকজন এসেছিলেন। বড় দারোগা। বললাম, প্রজাপতিটা হারিয়ে যাবে, আপনি ওকে নিয়ে যান। শুনলেন না। আমার মনে হয় পাকিস্তান থেকে এসেছে। হারিয়ে যাবে কিন্তু।
সন্ধ্যে হয়ে রাত গড়িয়েছে। ছেলে বারান্দায় একটা কাঠের চেয়ারে বসে। একদিকে হাতলটা নেই। মাথার উপরে ডুম জ্বলছে। কোলের উপর বই। পড়া যায় না। তাকানো যায়। গীতা। ঠাকুর্দার ছিল। এখন আঠারোটা অধ্যায় নেই। ইঁদুরে খেয়েছে। বারোটা অধ্যায় আছে।
যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। অর্জুন পুকুর ধারে বসে আছে। কৃষ্ণ জলে নেমেছেন স্নানে। সারাদিনের যুদ্ধের ক্লান্তি। চাঁদ উঠেছে। কৃষ্ণের ভেজা গায়ে চাঁদের আলো। আলো মাখছেন কৃষ্ণ। বলছেন, অর্জুন, একা লাগছে?
অর্জুন বলছেন, হ্যাঁ।
কৃষ্ণ বলছেন, গান গাও। একা লাগবে না।
মা গান গাইছে। চৌকিতে শুয়ে। চৌকিতে একটা মাত্র শতরঞ্জি পাতা। মায়ের হাড়ে লাগে। কিন্তু কী করবে? কত কাচবে? মা কুঁকড়ে শুয়ে আছে। যেন সদ্য জন্মানো শিশু। মা গাইছে, “আমি মথুরা নগরে প্রতি ঘরে ঘরে যাইব যোগিনী হয়ে”।
নীল প্রজাপতিটা জানলার উপর বসে। ইচ্ছা করলেই উড়ে যেতে পারে। তবু যাচ্ছে না। সবাই যায় না। কেউ কেউ যায়।