‘গেহেরাইয়া’ দেখে আবার দীপিকা পাডুকোনের প্রেমে পড়লাম। ভয়ানক প্রেমে পড়লাম। এমন অভিনয় যেন বহুকাল দেখিনি। এ অবশ্য বাড়াবাড়ি কথা, তবে প্রেমে পড়লে অমন বাড়াবাড়ি মার্জনীয়। তা দীপিকা করলটা কি? একটা চরিত্রে অভিনয় করল। কেমন চরিত্র? ইংরাজিতে 'ফ্র্যাজাইল' বলে না? মানে বেশ টলোমলো চরিত্র। তেমন চরিত্র আর কি। ছোটোবেলায় মায়ের আত্মহত্যা। বড়বেলায় তেমন কিছু একটা মারকাটারি সফল হতে না পারা। তার উপর ঘাড়ে চড়ে বসা এক সুবিধাবাদী বয়ফ্রেণ্ডগোছের মানুষ। এরমধ্যে এসে পড়া এক বাঁধনহীন, তুমুল প্যাশনেট প্রেমিক। তারপর গল্পের গোরুর গাছে চড়া। সে চড়ুক। আমার গোরু নিয়ে কাজ নেই, আমার প্রাণ বিঁধেছে দীপিকার চোখ। তো কথা হল অনেকের সিনেমাটা ভালো লাগেনি। মানে ক্রিটিকদের, সিনেমাপ্রেমীদের। আমার কেমন লেগেছে আমি বোঝার অবকাশ পাচ্ছি না, শুধু দীপিকা পাডুকোনের অমন পাগল করা চোখের চাহনির জন্য। সে চোখের সঙ্গে সমুদ্দুরের ঢেউয়ের উচ্ছ্বাস, আর বিলি ইলিশের ইন্ডিয়ান ভার্সানে সেই কোতপাড়া চরম আবেগী গান… আহা! যেই শুনেছে সেই বুঝেছে।
আচ্ছা, ভালোবাসবে অথচ ঘায়েল হবে না, সেকি হয়? ভালোবাসা আর জ্বরের মধ্যে পার্থক্য কি? জ্বর প্যারাসিটামলে ছেড়ে যায়, আর ভালোবাসা কিছুতেই ছাড়ে না। সে অবহেলা করুক, দুচ্ছাই করুক, পাত্তা দিক চাই না দিক, তবু ছাড়ে না। সারাক্ষণ ছায়ার মত, ছাতার হাতলের মত ধরে ধরে বেড়াও। কাকে? তাকে, আবার কাকে। সে অদৃশ্য হয়ে তোমার মনের আবদার তখন। এদিকে তুমি প্রেমের ঘোরে হেদিয়ে মরছ, ওদিকে উনি হয় তো ফুচকা খেয়ে, রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়ে, আমোদ আহ্লাদ করে দিব্যি দিন কাটাচ্ছেন। নিজেকে দেখে রাগ লাগবে, ঘোরের মধ্যে তার গুষ্টির তুষ্টি করবে। কিন্তু আদতে কিস্যু হবে না। যখন সে ঘোর কাটার তখনই সে কাটবে। এখন কোথায় কিভাবে সে ঘোর কাটবে বলা কঠিন। হয় ধাবার মাঠে, অতীতের আবর্জনা সব নিপাত যাক টাইপের অনুভূতি হয়ে; নয় কাশীতে, কেহ কারো মন বোঝে না, টাইপের দার্শনিক হয়ে; নয় তো বৃন্দাবনে, 'ওগো তুমি যে আমার' টাইপের হয়ে, তারপর হাগিস, জনসন এণ্ড জনসন, সেরেল্যাক অবধি পৌঁছে। সব হয়। কোনটার স্ট্যাটেস্টিক্স কতটা সে যারা এসব নিয়ে গবেষণা করেন তারা বলতে পারবেন।
প্রেমিক মানেই এক একজন গ্ল্যাডিয়েটর। দর্শক কে? পাড়া-প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধব তো রইলই, সঙ্গে মনের মধ্যে জমানো গাদা গাদা উপদেশ, সৎবুদ্ধি, এরা সবাই দর্শকাসনে বসে। কেউ কোনো কাজে দেয় না গো! একজন নিষ্ঠুরের মত আপনার কলিজা নিয়ে এই ফ্রাইংপ্যানে দিচ্ছে, এই মাইক্রোওয়েভে বসাচ্ছে, এই কাঠফাটা রোদে ছাদে রেখে ভুলে যাচ্ছে, আপনাকে সব সহ্য করে যেতে হবে। ঈশ্বরকে ডেকেছ তো আরো গেছো, সব উপদেশের ঝুলি নিয়ে মহাপুরষেরা এসে বলবে, সংসার মায়া, সব মন তুলে নাও, কেউ কারো নয় ইত্যাদি ইত্যাদি। তা এখন কোন মনে আর কোন বুদ্ধিতে মহাপুরুষদের এ সব কথা শুনি বলুন? মন বুদ্ধির কানেকশান কি আর আমার সঙ্গে আচ্ছে? সে ইয়ে করে ফ্ল্যাশ করলে আমি এখান থেকে তার আওয়াজ শুনতে পাই, সে পাশ ফিরে শুলে আমি তার খাটের ক্যাঁচক্যাঁচ আওয়াজ পাই যোজন যোজন দূর থেকে, সে সুমেরুতে বসে হাই তুললে আমি তার মাজনের গন্ধ পাই কুমেরু থেকে। আমার কি আর আগের মত দিন আছে দাদা যে আমি আপনাদের সদুপদেশ শুনে জীবনটাকে সামলাই। বোঝে কে? যদিও বা তিনি বৃন্দাবনলীলায় কিছু একটা বুঝে ছিলেন, কিন্তু তারপর ওই বোষ্টুমগুলো এসে কি আর তাঁকেও ছেড়েছে? মায় তিনি যে একটু গোপীনিদের নিয়ে গিয়ে রেস্টুরেন্টে গিয়ে বিরিয়ানী খাবেন, সে জো-ও নেই। অমনি সব তুলসীমালা ধারীরা এসে বলবেন, একি প্রভু? নিরামিষ খাও, একি ম্লেচ্ছদের খাবার অর্ডার দাও।
নাও। কি বলবে বলো? গোবিন্দকে একজনই বুঝেছিল, সে হল আমাদের কবি জয়দেব, আহা গীতগোবিন্দ পড়লে বোঝা যায়…উফ কি কথা থেকে কি কথায় এলুম। থাক সে বৃন্দাবনলীলার কথা।
এখন তবে উপায় কি? ভুল প্রশ্ন। প্রেমের কোনো পথই নেই। কারোর কোথাও যাওয়ার নেই। ডোবার আছে। মরণ রে তুঁহু মম শ্যাম সমান। তবে ডুবে কি পাওয়ার আছে? কিস্যু নেই, আবার ভুল প্রশ্ন। মরার আছে, দাদা পুরোদস্তুর মরার আছে। এমন ভাড়াটিয়া যদি কেউ বসায়, যে ভাড়া দেয় না, এদিকে সারাটা ঘরবাড়ি নিজের ইচ্ছামত সাজায় গোছায়, মাঝরাতে নয় নেত্য করে, না হয় গান গায় গলা ছেড়ে, না হয় কেঁদে ভাসায়, তখন বাড়িওয়ালা কি করে? তেমনই নিজের মন-বুদ্ধি-হৃদয় যখন কত্তার কথা না শুনে অমনধারা ভাড়াটিয়ার মত করে, তখন বাড়িওয়ালা গায়, মরণ রে তুঁহু মম শ্যামসমান।
প্রেমের জগত উল্টা জগত। আসামী বিচার চায় না, যে ফরিয়াদী আসামীর সঙ্গে ফাঁসি চায়। বিচারক কানে দেখে, চোখে শোনে। এর মধ্যে কোথায় শান্তি? এও এক কথা, কেউ শান্তি চায় না।
এরপর কি হয়?
এরপর প্রেমিক বিজ্ঞ হয়ে ওঠে। এঁড়ে দার্শনিক হয়। প্রেমের কথা বললে বয়েস দেখায়, আধার কার্ডকে সাক্ষী মানে। সংসারে হিসাব বাড়ে। প্রেম ছবির অ্যালবামে বাদামী হয়। গন্ধ হয়। ন্যাপথলিন কি পাওডারে মাখামাখি হয়। হাঁপিয়ে উঠে পালিয়ে যায়। প্রেম তখন আবার নতুন শিকার খোঁজে। আবার নতুন করে কেউ দীপিকার চোখে ঘায়েল হয়। নিজেকে খাদের ধারে দাঁড় করায়। আবার দখিনা বাতাস বয়। রক্তের মধ্যে জয়দেব আসেন গীতগোবিন্দ নিয়ে।