Skip to main content
 
 
গঙ্গার ধারে যখন পৌঁছালাম তখন আকাশের ব্রাইটনেস কমার মুখে, চার্জ ফুরিয়ে আসছে সূর্যের। বাইকের পেছনে বসে যেতে যেতে নাকে আসছে চারদিকে পাট পচানোর গন্ধ – দুর্গন্ধ। রাস্তার দু'ধারে কোমর জলে নেবে মহিলা পুরুষ পাটের গা থেকে আঁশ ছাড়াচ্ছে। আকাশে শরতের রঙ কয়েক পোচ পড়তে শুরু করেছে দেখা যাচ্ছে।
      গঙ্গার ধারে কতগুলো নৌকা বাঁধা। এক নৌকায় মাঝি এক বাচ্চা ছেলে – যেন ‘কোথায় পাব তারে’ –এর নায়ক সেই খুদে কালকূট। তার মাথায় লাগা ডুবন্ত সূর্যের নির্মল আশীর্বাদ। তার ঠাকুমার তীক্ষ্ণ নজর নাতির দিকে, পাড়ে দাঁড়িয়ে। অশক্ত শরীরে দাঁড়ানো যায় না বেশিক্ষণ, বসে পড়লেন। খালি পা, ছেঁড়া ছেঁড়া সবুজ শাড়ি একটা, বারবার নবীন মাঝিকে বলছেন – সাবধান!
 
      মাথার উপর ঘুড়ির বাতাস কাটার আওয়াজ। ঘুড়ির সুতো লাটাই থেকে ছাড়ছে এই আশেপাশের গ্রামের ছেলেরা, কি প্রচণ্ড দৌরাত্ম্য সারা মাঠ জুড়ে। মাঠের একদিকে পাঠকাঠি জড়ো করে রাখা, টাঙানো বাঁশে শুকাচ্ছে পাটের আঁশ, এখানে ওখানে ছড়িয়ে নীলরঙের জাল – মাছ ধরতে যেতে হয় রাত হলে, সকালে পাটের কাজ।
 
    

 “বাবা, পাটগুলো নিয়ে তুমি শুকুতে যাবা কখন”, এক কিশোরের প্রশ্ন, একটা ঢোলা গেঞ্জি রোগা শরীরটা বেড় দিয়ে গঙ্গার হাওয়ায় উড়ছে, বাবা নৌকা পরিষ্কার করছে, গঙ্গাপাড়ের মাটি বিক্রি করে এই তো সদ্য লাগল পাড়ে, দুপুরের খাওয়া হয়নি, কিন্তু নৌকাটা ধুয়ে স্নান না করে খেয়েই বা কি সুখ?

      বাবা গঙ্গার জলে একটা ডুব দিয়ে, মাথা উঁচিয়ে বলল, "কাল যাব।"
      ছেলে নৌকার হাল নিয়ে খেলছে নৌকায়। নৌকা দুলছে। পাড়ে বাঁধা মোটা দড়িতে দুলুনির টান পড়ছে, মাটি আঁকড়ে লোহা, নৌকা বাঁধা তাতে।
      ছেলেটা বলল, "আর পূজোর জামা, আজ যাব বাজারে? মা বলছিল?"

      ছেলেটার চোখ তোলা আকাশের দিকে। বক উড়ছে এক ঝাঁক, তার পাশে সেই লাল ঘুড়ি, খানিক দূরে সেই ঘুড়ির মালিকদের গলা না ভাঙা কণ্ঠের উল্লাসের আওয়াজ, কান বাবার উত্তরের দিকে।
      বাবা ততক্ষণে পাড়ে উঠে লুঙ্গিটাকে পরা অবস্থাতেই নিংড়াচ্ছে, খালি গায়ে চকচক করছে ডুবন্ত সূর্যের আলোর খেলা। কতটা দূরে সূর্যটা? ওই তো ওপারেই ডুবছে। একটা দোতলা বাড়ির পিছনে। উঠবে কিন্তু ওই দোতলা বাড়ির পেছন থেকে নয়, উঠবে ওই মাঠের বড় বড় ইলেকট্রিক পোলগুলোর মাথা ছুঁয়ে। কি করে? সারারাত চুপি চুপি ডুব সাঁতারে গঙ্গা পেরোয়? হবেও বা। কেউ তো দেখেনি কোনোদিন ওকে গঙ্গা পেরোতে।
      বাবার উত্তর এলো, "আজই।"
      ছেলে ততক্ষণে নৌকা থেকে নেমে বাবার পিছন পিছন একটা পাটকাঠি নিয়ে পরিব্রাজকের ভঙ্গীতে হাঁটতে শুরু করেছে। বাবা বলল, "পা’টা ধুয়ে নে।"
      ছেলে খালি পা-দুটো জলে চুবিয়ে, আবার মাটি মেখে বাবার পিছন পিছন এসে ঘাসে মাটি-জল পা মুছতে মুছতে বলল, "একটা জিন্সের প্যান্ট... মা বলছিল।"
      বাবা প্রণাম করছে। সূর্য, প্রণামের উত্তর দিচ্ছে, তার গা থেকে একটা সোনালী আলোর রেখা বড় অশ্বত্থ গাছটার কোল ঘেঁষে বাবার মুখে এসে পড়েছে, ঠিক তক্ষুণি একঝাঁক পাখি সূর্যের গায়ে ডানা ঝাপটিয়ে উড়ে গেল। পুড়ে গেল না। সূর্য পোড়ায় না, আলো দেয়। লোকে মিথ্যা কথা বলে।
      বাবা বলল, "আচ্ছা।"

 
 
 
 
    

 সাইকেলের পিছনে একটা পরী বসে ততক্ষণে, সে এসেছে গঙ্গা দেখতে, তার বাবার সাথে। সে তো সদ্য কথা শিখেছে, তাই সে জানে না, ভাষার সাথে কালের কি সম্পর্ক। সে তার ছোট্টো শরীরটাকে সাইকেলের কেরিয়ারের সাথে আটকে, সিটের গলায় হাতদুটো জড়িয়ে বসে, গঙ্গার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে। "নৌকার গলায় মালা কে দিল লে বাবা?"
      বাবা, একটা হাফপ্যাণ্ট আর টি-শার্ট পরে নিজের নৌকার দিকে তাকিয়ে, নিঃশব্দ তদারকির দৃষ্টি, সে বলল, "জানি না মা।" সত্যিই তো তার নৌকার গলায় মালা।

      মেয়ে বলল, "ওপালে কি আছে?"
      বাবা বলল, "লোক থাকে।"
      মেয়ে গম্ভীর হয়ে বলল, "কই?"
      তাই তো, হোক না ওপার, কিন্তু সে পারের লোকেরাই বা কেমন, সে এসে তার বাবার সাইকেলের পিছনে অমন একটা নীলের উপর সবুজ ফুল আঁকা জামা পরে বসবে আর তারা এসে দাঁড়াবে না? তাও কি হয়?

      বাবা অন্যমনস্ক। তবু বলল, "গঙ্গায় নাইবি রে মা?"
      বাবার মুখে দুষ্টু হাসি।
      বাবা এই খেলাটা রোজ খেলে, কেন খেলে? জানে না তার জলে ভয়? ভীষণ ভয়।
      সে গম্ভীর হয়ে বলল, "এখন না, পলে।"
      এমন সময় হইহই আওয়াজ। কি হল, কি হল? মেয়েটা আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখল একটা লাল ঘুড়ি দুলতে দুলতে নামছে।
      মেয়ে ডান হাতের তর্জনীটা উঁচিয়ে বাবাকে বলল, "বাবা... উই..."

 
     
কিন্তু ততক্ষণে 'হারেরেরে...' কোত্থেকে এসে পড়েছে ঘুড়ির দস্যুর দল। লাফিয়ে ছিনিয়ে নিয়ে লুকিয়ে দিল জড়ো করা পাটকাঠির ফাঁকে। তারপর কি ধুন্ধুমার কাণ্ড। কে নিয়েছিস? কই রেখেছিস? দেখে নেব?
      বাচ্চা মেয়ে তখন অন্যদিকে তাকিয়ে, গঙ্গার পাড়ে পড়ে ঘট। ঘটের মধ্যে জলের ঢোকা বেরোনোর আওয়াজ, "বাবা ওকি জল খাচ্ছে?"
      বাবার বিড়ির ধোঁয়া মাখা সূর্যাস্তের আলো। ধোঁয়া মিলিয়ে যাচ্ছে। একটু পর আলোও মেলাবে।
 
     

কোনো এক মৃতের ভাতসরা দেওয়া শূন্য পাত্র। নেভা প্রদীপ। বিসর্জিত বিশ্বকর্মার অবয়ব। যে মানুষটা মারা গেছে, হয়ত এই গ্রামেই এসে উঠেছিল একটা চালা বেঁধে, তার জন্মভূমি থেকে উৎখাত হয়ে। জন্মভূমি শুধু মাটির তো নয়, রক্তের, শ্বাসের, ভালোবাসার, কান্নার, স্বপ্নের আর মায়ের। ছেলেবেলা ছিঁড়ে উৎপাটিত হওয়ার সময় যা হয় তা শোক কি গো? সে তো আর্তনাদ। ওই যে একটা বেড়ায় হাত দিয়ে আশির বেশি বয়েস হয়ে যাওয়া ঝুঁকে পড়া মানুষটা সূর্যাস্ত দেখছে, ওর এটা ভিটে নয়, আশ্রয়। ভিটে ছাড়লে মানুষ আশ্রয়হীন হয়, আশ্রিত মানুষকে উৎপাটিত করলে দেশ প্রতিশ্রুতিহীনতার পাপে অমানুষের ভারে ডোবে।

      হয়ত ছানি পড়েছে চোখে, বুড়িটা লাঠিকে ইন্দ্রিয় করে এগোচ্ছে। সামনের মন্দিরের দিকে এগোচ্ছে। গলায় কণ্ঠি। বৈষ্ণব। সাদা শাড়ির পাড় মাটিতে লুটোচ্ছে, তার পিছনে পিছনে তার নাতনি, একটা শতচ্ছিদ্র চকমকে ময়লা জামা গায়ে, কিশোরী সে। সামনের গাছের আড়ালে অন্ধকারে একজন দাঁড়িয়ে, সাইকেল নিয়ে, হাতে স্মার্টফোন। কিশোরীর সাথে চোখাচোখি, হাসি বিনিময়। সূর্যাস্ত হয়ে গেছে। আকাশে আলোর ছিঁটেফোঁটা রঙ, যেন অনমন্যস্ক কিশোর হাত রঙের ডালা নিয়ে যেতে যেতে ফেলে ছড়িয়েছে ইতিউতি।
      মন্দিরে প্রণাম করছে ঠাকুমা। নাতনি মন্দিরের থেকে একটু দূরে। সাইকেল এত জীবন্ত হয়, এই প্রথম দেখলাম, সাইকেলের হাতলে রাখা তার হাত, আরেক হাতল ধরে ছেলেটা। দূরে শাঁখ বাজছে। গঙ্গার জলে উদাসীন বয়ে চলার আওয়াজ। আকাশ শোনে রাতদিন। মানুষ ভালোবাসার কথা বলে। মানুষ আশার কথা বলে। মানুষ আধপেটা খেয়েও মানুষের কথা ভাবে। জীবনের কথা ভাবে। স্বপ্নের জন্য বাঁচে। পরেরদিন সকালে দেবতাকে ক্ষমা করে সমস্ত যন্ত্রণা ভাগ্যের ঘাড়ে চাপিয়ে মানুষ রাস্তায় নামে। জীবিকা – মানে বাঁচার পথ – লোভের উপায় বা পাপের পথে সঞ্চয়ের কথা ছিল না, মনে করায়। সমস্ত গায়ে ধুলোমেখে পৃথিবী ভালোবাসায় জড়িয়ে ধরে মানুষকে। তার একটা হাতলে হাত রাখে সুখ, আরেক হাতলে হাত রাখে দুঃখ। মানুষ বাঁচে। গঙ্গা বয়ে যায়। প্রতিদিন নতুন ভোর হয়।

 
     আমি ছবি তোলার ব্যকরণ জানি না। তবু কয়েকটা মুহূর্তের সাক্ষী হিসাবে ক্যামেরার ভাষাকে রাখলাম, ক্যামেরার শিল্পী হিসাবে নয়।
 

Category