Skip to main content
গান্ধী - দ্য ইয়ার্স দ্যাট চেঞ্জড দ্য ওয়ার্ল্ড


        কেন গান্ধীকে নিয়ে আরেকটা বায়োগ্রাফি? রামচন্দ্র গুহ বলছেন, আজকের দিনে দাঁড়িয়ে আরেকবার দেখতে চাওয়া জীবনটাকে। এ খণ্ডটা যদিও 'গান্ধী বিফোর ইণ্ডিয়ায়' র পরের অংশ, তবু বইটাকে ঠিক সিক্যুয়েল বলা যায় না। এই খণ্ডটাকে পড়ার জন্য যে আগের খণ্ডটা পড়তেই হবে তার কোনো কথা নেই। বইটা স্বয়ং সম্পূর্ণ বই একটা। 


        বইটার সময়কাল ১৯১৪ থেকে ১৯৪৮। লেখক পাঁচটা অনুচ্ছেদে ভাগ করেছেন। গান্ধীকে কেন্দ্র করে ভারতীয় রাজনীতি তথা কখনও কখনও বিশ্বের খণ্ডচিত্রও এসে পড়েছে। কিন্তু এমন একটা নির্মোহ, নিন্দা-স্তুতিহীন, অগভীর আবেগহীন জীবনী পড়ার সুযোগ পাওয়া পরম ভাগ্যের। আমাদের দেশে এমন একটা জীবনী পাওয়াও খুব একটা সহজলভ্য নয়। এই বইতে গান্ধী মহাত্মাও নন, আবার দুরাত্মাও নন। একজন মানুষ। যে মানুষটা আমাদের খুব কাছের আবার কোথাও যেন বড্ড অন্যরকম। কেন অন্যরকম? তার খোঁজ আছে পাতায় পাতায়। জীবন গড়িয়েছে রাজনীতি থেকে যৌনতা, ধর্ম থেকে চিত্ত-দুর্বলতা সব কিছু নিয়ে। কিছুকে আড়াল করার প্রয়াস যেমন নেই, তেমনই নেই যা মাহাত্ম্য তাকে কুটিল সন্দেহের চোখে দেখে ক্ষুদ্রতায় কলুষিত করার চেষ্টা। 


        রবীন্দ্রনাথ এসেছেন বারবার। গান্ধী বারবার তাঁর কাছে ফিরে ফিরে যাচ্ছেন। পরামর্শ চাইছেন। আলোচনা করছেন। দ্বিমত হচ্ছেন। তবু তিনি যেন গান্ধীর পরম আশ্রয় হয়ে উঠেছেন, দিশারী হয়ে উঠছনে বারবার। গান্ধী পুণেতে জেলে। পুণা অ্যাক্টের জন্য অনশনে। জীবন সংকট দেখা দিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ পরম উদ্‌বিগ্নতা নিয়ে যাচ্ছেন তাঁর সাথে দেখা করতে তাঁর সত্তরোর্দ্ধ শরীরটা নিয়ে উত্তরভারতের গ্রীষ্মকালের তীব্র দাবদাহ উপেক্ষা করে। দুদিনের রেলযাত্রা। পৌঁছালেন জেলের দ্বারদেশে। ঝুঁকে পড়া শরীরটা নিয়ে ধীরে ধীরে এগোচ্ছেন ক্ষীণদেহ-সংকটাপন্ন গান্ধীর দিকে। পরে নিজে একটা প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ সে সাক্ষাৎ নিয়ে লিখছেন, এমন অশক্ত শরীরে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও গান্ধীর চিন্তার ক্ষমতা বিন্দুমাত্র হ্রাস হয়নি। গান্ধী ধীরে ধীরে চোখ মেলে চাইলেন। মুখে আনন্দের ঢেউ খেলে গেল। তিনি একটু ওঠার চেষ্টা করে রবীন্দ্রনাথকে বুকে টেনে নিলেন। তারপর তাঁর অশক্ত কাঁপা কাঁপা হাতে রবীন্দ্রনাথের দাড়ির মধ্যে হাত দিয়ে বাচ্চাদের মত আঁচড়াতে লাগলেন। তারপর ঘুমিয়ে পড়লেন। 


        এমন অনেক ছোটো ছোটো মূহুর্ত তুলে এনেছেন রামচন্দ্র গুহ। তিনি বিশেষ বিশেষ মানসিক অবস্থার বিশ্লেষণে নানা চিঠিপত্রের সাহায্য নিয়েছেন, নিজের অনুমানের উপর নির্ভর করেননি সব জায়গায়। অজস্র চিঠিপত্র, অজস্র পত্র-পত্রিকার উদ্ধৃতি সারা বইটা জুড়ে। সেইগুলো জুড়ে জুড়েই এই জীবনী। ফলে এ যেন একই সাথে এক ঐতিহাসিক দলিল হয়ে উঠেছে। 


        আমাদের সমস্যা হল, আমাদের পড়ার সময় না থাকলেও আলোচনার সময় থাকে, গভীর গিয়ে বিশ্লেষণের আন্তরিক ইচ্ছা না থাকলেও নিন্দার ইচ্ছাটা থেকেই যায়। আমি বেশির ভাগ মানুষকেই বলতে শুনি, "বাপরে এতবড় বই? পড়ব কখন? আমার যে মেলা কাজ?” কিন্তু সেই মানুষটাই কখনও বলে না, "বাপ রে এতবড় মানুষটার নিন্দা করি কি করে, আমার যে তেমন করে ভেবে দেখার সময়ই হয়নি।" এই দ্বন্দ্ব চিরকালের। এই শুনতে শুনতে চুলে পাক ধরল, অহং এর সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম দাপটের খেলা এখন আর বিভ্রান্ত করে না, তাই এরকম একটা বই পেলে নিজেকে নিয়ে নিঃশব্দে নিজের মধ্যের নির্জনে পাড়ি দিই। আত্মশুদ্ধি ঘটে। আত্মশুদ্ধি ঘটে বিশ্বাসে না, তর্কে না, আন্তরিক সত্যের সামনে দাঁড়াবার নম্র ইচ্ছায়, সেই সাধনা। মহাত্মা আমার চিরকালের অতৃপ্ত তৃষ্ণা, এ মেটার নয়, ফিশার থেকে গডসে সবই পড়তে পড়তে আজ রামচন্দ্র গুহতে এসে একটা অদ্ভুত আনন্দ পেলাম। আমার সেই স্কুল জীবন থেকে পক্ষে-বিপক্ষে পড়ে আসা গান্ধীর সাথে রামচন্দ্রের সেই সময় থেকে জীবন্ত করে তোলা গান্ধীর সাথে কি অপূর্ব মিল। এমনটাই তো চেয়েছিলাম - মাটির প্রদীপে আলোক শিখা। তা পেলাম। 


        একটা কথা বলে শেষ করি। রামচন্দ্র গুহকে একটা বিশেষ কারণে মেল করতে হয়েছিল। সাথে আমি যে এই বইটা পড়ছি সেটাও জানিয়েছিলাম। তিনি মেলের উত্তর দিয়েছেন এত ব্যস্ততার মধ্যেও, বলেছেন আমি যেন আমার পাঠ-প্রতিক্রিয়া জানাই ওনাকে, এমনকি তা সমালোচনামূলক হলেও যেন জানাই। যে বইটার আলোচনা পৃথিবীর সব বড় বড় পত্র পত্রিকায় শুরু হয়ে গিয়েছে সেই বইয়ের সমালোচনা আমার মত একজন অপরিচিত মানুষের কাছ থেকে শুনতেও তিনি আগ্রহী। আমার শ্রদ্ধা আরো বেড়ে গেল। আর অবশ্যই এরকম একটা বই লিখতে যে কি পরিশ্রম করতে হয় তা না ঘেঁটে দেখলে বোঝা সম্ভব নয়। অনুগ্রহ করে বিরুদ্ধে বা পক্ষে যাই নিয়ে আলোচনা করতে চান গান্ধীকে নিয়ে, আমার অনুরোধ এই বইটা না পড়ে করবেন না। নিজেকে বঞ্চিত করবেন না।

বই - গান্ধী - দ্য ইয়ার্স দ্যাট চেঞ্জড দ্য ওয়ার্ল্ড 
লেখক - রামচন্দ্র গুহ
প্রকাশক – পেঙ্গুইন
পাতা সংখ্যা - ১১৩০
মূল্য – ৯৯৯ টাকা ( অ্যামাজন, ফ্লিপকার্টে প্রচুর ছাড় দিচ্ছে)

 

Category