Skip to main content
গল্প গল্প

মানুষটা সেই কিশোরবেলায় কাকে যেন ভালোবেসেছিল। কাকে সে আমি বলতে পারব না। তবে শুনেছি, সে নাকি তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল। অন্য কারোর সাথে ঘর বেঁধেছিল। কি খারাপ না? কিন্তু এমন তো প্রায়ই হয়, হয়ে চলেছে সেই আদিযুগ থেকে। তা বলে কি কেউ ভাবতে পারে বলো যে এমনটা তার সাথেও ঘটবে? কেউ ভাবতে পারে না। এই মানুষটাও পারেনি। প্রথম কয়েক বছর নাকি খুব কেঁদেছিল। তারপর চুপ হয়ে গেল। কিন্তু ভিতরে ভিতরে তুষের আগুনের মত ধিকিধিকি কষ্টটা তো তার জ্বলতই। তাই সে যখন যৌবনে পা দিল, খুব রাগী হল। যাকে বলে উৎকট রাগী, ঠিক তেমনটা নয়। অভিমানী। 
প্রথমটায় সে ঠিক করেছিল, কাউকে ভালোবাসবে না আর। কাউকে না মানে, কাউকেই না, কখনও না। কিন্তু তাই কি হয় বলো? প্রশ্বাস নিলে যেমন নিঃশ্বাস বেরোয়, তেমন ভালোবাসা পেলে ভালোবাসা তো বেরিয়েও আসে। সে পড়ল মহা মুশকিলে। এদিকে না ভালোবেসে থাকার যো নেই, ওদিকে ভালোবাসার ফাঁদে পা দেওয়ারও আর ইচ্ছা নেই। কি করে? রাতদিন সে ভাবতে থাকে, কি করা যায়... কি করা যায়...
হঠাৎ একদিন সে একটা ফিকির ঠাওরালো। সে ঠিক করল, ভালো সে বাসবে সবাইকেই, কিন্তু মিছিমিছি। মানে সে ভালোবাসার ভান করবে, কিন্তু ভালোবাসাকে কিম্বা ভালোবাসার পাত্রকে বিশ্বাস করবে না। তাই হল। মনে মনে সে সবার দোষ ধরে বেড়াত। রোজ রাতে শুতে যাওয়ার আগে সে সবার দোষগুলো একটা বাঁধানো মোটা খাতায় লিখে সিন্দুকে তালা দিয়ে রেখে দিত। ভালোই চলছিল সব, লোকের দোষ খোঁজা কি আর এমন কঠিন কাজ। কঠিন কাজ হল সেই দোষগুলোকে বিশ্বাস করা। ভালোবাসার সাথে বিরোধ লাগে যখন তখন। ভালোবাসা তার খাতা কেড়ে নিতে চায়, পুড়িয়ে দিতে চায়, হারিয়ে দিতে চায়। অথচ সে জানে, লোকের সাথে এই দোষের আড়াল যদি না থাকে, তবে যে কোনোদিন যে কেউ তাকে ছেড়ে চলে যাবে, আর সে আবার সেরকম কষ্ট পাবে সেই আগের মতন। না, কখনও সে তা হতে দিতে পারে না আর নিজের সাথে। কখনও না... কখনও না। 
তবু তার মধ্যে শান্তি নেই। কাউকে সে চায় না। একদিন ঠিক করল, সে একটা অজানা পাহাড়ে চলে যাবে। একা। মানচিত্র খুলে বসল। অনেক খুঁজে একটা পাহাড়ের হদিস পেল। একদম নির্জন একটা পাহাড়। কেউ জানে না, কেউ যায় না। 
সবাইকে না বলে সে সেই পাহাড়ের দিকে রওনা দিল। পুরো এক বছর হেঁটে সে যখন পাহাড়ে উঠল, তার মনে হল তার যেন কত বয়েস হয়ে গেছে। তবু সে উঠল। একটা গুহা খুঁজে পেল। "ব্যস... আর কি চাই!" - সে নিজের মনে মনে বলে, সেই গুহায় থাকতে শুরু করল। সাথে আনল তার সেই দোষের খাতার বাক্স। যেই কারোর জন্যে তার মন উতলা হয়, অমনি সে সেই বাক্স খুলে তার একটা একটা করে দোষ পড়তে শুরু করে। ব্যস মনটা থতমত খেয়ে চুপ করে যায়। 
একদিন এরকমই একটা কারণে সে বাক্স খুলেছে, দেখে এ কি! বাক্সের মধ্যে একটা গাছের চারা! কি করে হল? সে চারাটাকে তুলে বাইরে পুঁতে দিল। পরের দিন আবার একটা চারা। আবার সে সেটা মাটিতে পুঁতে দিল। এইভাবে রোজ একটা একটা করে দোষের খাতা একটা একটা চারাগাছ হয়ে উঠতে লাগল, আর সে বিস্মিত হতে হতে তাদের মাটিতে পুঁতে দিতে লাগল। একদিন পুরো বাক্সটা তার ফাঁকা হয়ে গেল, ওদিকে পুরো বাগানটা তার ভরে উঠল চারাগাছে। ক'দিনের মধ্যেই চারাগাছগুলো হড়হড় করে বড় হয়ে গেল। তাতে ফুল ফুটতে লাগল। কি আশ্চর্য্য, এক একটা ফুলের আকৃতি তার সেই খাতায় লেখা মানুষগুলোর মুখের মতন। তার আর বিস্ময়ের সীমা পরিসীমা রইল না। কি করে হয়! 
একদিন জ্যোৎস্নারাত। সে একা বাগানের মধ্যে বসে। মনটা ভীষণ উদাস। অনেকের কথা মনে পড়ছে, অথচ তাদের দোষগুলো মনে পড়ছে না। কিছুতেই মনে পড়ছে না। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তার, সবার জন্য ভালোবাসা তার বুকের ভিতর ঝরণার মত নামছে অজস্র ধারায়, আর সে প্রাণপণ চেষ্টা করছে তাদের আবার বুকের গুহায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে, দোষের পাথরের আড়াল করে রাখতে। হচ্ছে না। সে নিজেই যাচ্ছে ভেসে। অবশেষে সে হাল ছেড়ে দিল। উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল সে ঝরণার ধারার নীচে। তার উপর দিয়ে বয়ে চলেছে ভালোবাসার ঝরণার স্রোত, তৈরি হচ্ছে নদী তাকে অববাহিকা করে। 
হঠাৎ তার পিঠে ছুঁলো খুব পরিচিত একটা হাত। সে চমকে ফিরে দেখে, তার সেই কৈশোর বয়সের ভালোবাসা। সে অবাক হয়ে তার হাত ধরে বলল, তুমি ছেড়ে যাওনি আমায়? ভালোবাসা বলল, “তা কি হয়? আমি যার বুকে জন্মাই তার বুক ছেড়ে যাই না কোনোদিন, যার জন্য জন্মাই সে ছেড়ে গেলেও না। ভালোবাসার পাত্র অবুঝ হয়, ভালোবাসা নয়।” 
লোকটা 'হাঁ' করে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। ভালোবাসা বলল, "একবার তাকিয়ে দেখো চারদিকে, তুমি যত দোষ জমিয়েছিলে সব ফুল হয়ে ফুটে রয়েছে, কেন জানো? তুমি ওদের দোষ খুঁজেছিলে ভালোবাসায়, ওদের ধরে রাখতে চাও বলেই ওদের এত দূরে সরিয়ে রাখতে চেয়েছিলে। পারো নি। কেউ পারে না। আমার পথের বাধা স্বয়ং মহাকাল যখন হতে পারে না, তখন তুমি তো তুচ্ছ মানুষ। শুধু জেনো, তোমার বুকে যে ভালোবাসা তা অসীমের আনন্দ প্রকাশের ভাষা, তার পাত্র তোমার হৃদয়। কিন্তু মালিক তুমি নও। যেমন তোমার চোখের মণিতে যে অনন্ত নীল আকাশের ছবি, সে কি তোমার চোখের? কখনও না। এও তেমন।"
লোকটা হতভম্ব হয়ে শুনছিল। এবার সম্বিৎ ফিরে পেয়ে বলল, "তবে যে বড় কষ্ট পাই।"
ভালোবাসা বলল, "পেও না। সমুদ্রকে দেখতে শেখো, ঢেউকে সমুদ্র বলে দেখো না।"
তারপর কি হল? কি আর আবার হবে? সে ফিরে এলো। এসে দেখে সবকিছু একই জায়গাতেই আছে। তবু যেন ভীষণ ঝকঝকে তকতকে চারদিক। ব্যস গপ্পো শেষ!
 

(ছবিঃ সুমন)