চায়ের উনুনে আঁচ। পাশে রুটির দোকানেও আঁচ। গনগন করে জ্বলছে। এদিকে চায়ের দুধ ফুটছে। ওদিকে গরম তাওয়ায় রুটি সেঁকা হচ্ছে। মাঝে মাঝে ডিম ফাটিয়ে প্যানে করে আগুনের মধ্যে দিয়েই অমলেট হচ্ছে। কখনও একটা ডিমের। কখনও দুটো ডিমের। যেমন খদ্দেরের খিদে, পকেটের স্থূলতা।
একটা সাদা বেড়াল এ দোকানের ছাদ থেকে সে দোকানে যাতায়াত করছে। লোকেদের ভিড় নীচে। চায়ের দোকানের ভিড়, রুটির দোকানের ভিড়। বেড়ালটা স্বস্তি পাচ্ছে না। তার গায়ের উপর দিয়ে আটকে আছে আকাশে মেলা চাঁদ। আধখাওয়া রুটির মত। বেড়ালটার যদি চাঁদ নিয়ে মাথাব্যথা নেই, সে নীচে তাকাচ্ছে বারবার।
এগুলো সব রেলকলোনির দোকান। সামনেই লাইন পেরোলে ওদিকে রেল কারখানা। এদিকে কলোনি। বেশির ভাগ কোয়াটার্স ফাঁকা। গাছ হয়েছে, সব ঝোপঝাড়ে ভর্তি। একপাশে কিছু শ্রমিকের অস্থায়ী বাসা। সন্ধ্যে হলেই ভাত রাঁধা হয়। হলুদ ডুমের আলোয় ভেসে যাওয়া ভাতের ধোঁয়া হিমেল হাওয়ায় উড়ছে। কিছু শ্যামাপোকা উড়ছে। একজোট হওয়া মানুষ গায়ে গায়ে বসে। ভীষণ কাছাকাছি। ঠাণ্ডা পড়েছে। এদিকে শীতের কামড়টাও তীক্ষ্ম।
ভাত হয়ে গেল একটু পর। থালায় থালায় বেড়ে দেওয়া হল। কেউ বসে, কেউ দাঁড়িয়ে। ভাতের থালা কেঁপে কেঁপে উঠছে হাতের তাড়নায়, আঘাতে আঘাতে। চোয়ালের পেশী শক্ত হয়ে উঠছে। মোবাইলগুলো কিছুক্ষণের জন্য শান্ত। পাশে রাখা। একটু পরে নামবে ঘুম।
চায়ের দোকানের পাশে কয়েকটা কুকুর। উল্টোদিকে কয়েকটা ঘর। বস্তি। বস্তির এক বউ গার্গেল করছে উঠানে বসে। মাথাটা আকাশের দিকে তুলে, চোখদুটো বিস্ফারিত করে, যেন গোটা আকাশ গিলে নেবে, সঙ্গে দেহ কাঁপানো ঘড়ঘড় আওয়াজ। টুলে বসে আছে শাড়িটাকে শক্ত করে ধরে। শালীনতা বড় স্পর্শকাতর জিনিস। একবার ফসকালে কতদিন ধরে কত মুখে যে গড়াবে কেউ জানে না। পাশে বসে তার আদুরে কুকুর। সারা গা ঘা। মালকিনের গার্গেল করা দেখছে। হাওয়া বদলাচ্ছে, এই সময় সর্দিগর্মি হবে না?
হবে তো। পাশে ছোটো একটা হোমিওপ্যাথি চেম্বার। সেখানে দুবেলা বসে কোনো প্রতিষ্ঠানে পাশ না করা ডাক্তার। বয়েস হয়েছে। ওষুধের দাগের চেয়ে দরদের দাগ বেশি। জ্বরটা হলে, কোনো বাচ্চার বমিপায়খানা হলে বাড়ি গিয়েও দেখে। বস্তির নোংরা কাপড়ের পর্দাটা সরিয়ে, মাথা নীচু করে, একগাল হেসে ভাঙা চেয়ারে বসে। কখনও সে জায়গাও জোটে না। ঝুঁকে দাঁড়িয়ে রুগীকে দেখে। ওষুধ দেয়। স্নেহ দেয়। আশ্বাস দেয়। যদি না সারে, বলে দেয় কখন ডাক্তার দেখাতে হবে। আসল ডাক্তার।
একবার রেললাইনের ধারে পাওয়া গেল এক মৃতদেহ। খুন। চায়ের দোকানে, রুটির দোকানে চাপা স্বরে কথা। শান্তি নেই। কৌতুহল বেড়ালের মত এ মুখ, সে মুখ, জিভ ডিঙিয়ে, চোখ ডিঙিয়ে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। লুকিয়ে লুকিয়ে পুলিশের গাড়ি দেখছে। পুলিশের সঙ্গে চোখাচোখি হলে অন্যদিকে তাকাচ্ছে। বাচ্চাগুলো পুলিশের কাছাকাছি এলে মায়েরা ত্রস্ত পায়ে এসে ছোঁ মেরে নিয়ে যাচ্ছে।
দুদিন গেল। ভয় গেল। কৌতুহল গেল। আবার শীত এলো। শ্যামাপোকা বাড়ি যাব যাব করছে। লালুভুলুরা ছেঁড়া বস্তা খুঁজছে। আগুনের আঁচের কাছাকাছি লোকের জমায়েত হচ্ছে। হাত ঘষার আওয়াজ। হাত ঘষে, গালে ঠেকানোর তৃপ্তিসূচক শব্দ আসছে - আহ!
নতুন চপের দোকান খুলল। সেও আবার একজন মহিলা। প্রথম প্রথম নিন্দে হল। সংশয়বেশী নিন্দে। পারবে? তারপর হল আরো নিন্দে। কেউ বলল, তেল বেশি। কেউ বলল, নুন কম। কেউ বলল, আরো ভাজা হত। কেউ বলল, দাম বেশি।
এদিকে ভিড় বাড়ল। রোজ বাড়ে। চায়ের দোকানে চপের স্বাদ এলো। রুটির দোকানে চপের স্বাদ এলো। মুড়ির দোকানে চপের স্বাদ এলো। মিষ্টিওয়ালার সিঙ্গাড়া বিক্রি কমল। সে অভিমান করে বলল, বেইমান।
কয়েক মাস যেতে না যেতেই চপের দোকান বন্ধ। সবার রাগ হল। এরকম করলে ব্যবসা টেকে? কি ভালো স্বাদ ছিল। দারুণ ব্যালেন্স সব। দামও বা আজকালের বাজারে এমন কি!
বন্ধ দোকানের টেবিলে এদিকে ওদিকে পোড়া তেলের দাগ। কুকুর বেড়ালগুলোও ভুলেছে একদিন এখানে চপ ভাজা হত। লোকেরা তাকায়, কাউকে না জানিয়ে। নিজেদের বঞ্চিত লাগে। কেউ কেউ ভাবে তাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা হয়েছে।
একদিন খুলল চপের দোকান। প্রথম প্রথম ভিড় হল কম। ইতস্তত ভাব। আজকেই যেতে হবে? হ্যাংলা নাকি? যাব দুদিন পর।
সে হলুদ শাড়ি পরে, ঘোমটা মাথায় বসে থাকে টুলে। ঝুড়িতে রাখা খবরের কাগজের তেল মাখানো বেগুনি, আলুর চপ, ডালের বড়া।
ধীরে ধীরে লোক বাড়ল আবার। অভিমান গেল লালরসের তাগিদে ভেসে। কেউ কেউ জিজ্ঞাসা করেই ফেলল, এতদিন আসোনি কেন?
গলায় চাপা অভিমান।
সে হাসল। লজ্জা ঘোমটা ঢাকা মুখের উপর আলতো পা ফেলে চলে গেল। বেড়ালের মত। ধরা দিল না।
মিষ্টির দোকানি সিঙ্গাড়া সাজিয়ে আবার বলল, ধ্যাত্তেরিকি!
চায়ের দোকানের আঁচের ধোঁয়া, রুটির দোকানের আঁচের ধোঁয়া আকাশে মিশে যেতে লাগল সব গল্প শুনতে শুনতে মানুষের। মানুষের গল্পের আর শেষ হয় না। বাচ্চারা ব্যাডমিন্টন খেলছে। ভাঙা ব্যাটে ক্রিকেট খেলছে। বড়রা খালি গল্প করছে। গল্পের পর গল্প জমছে। ভেসে যাচ্ছে হাওয়ায়। যে গল্প লেখা হয় না। লেখা যায় না।
বেড়ালটা ছাদে ঘুমিয়ে পড়েছে। রোদে শুকাতে দিয়ে তুলতে ভুলে যাওয়া হাফপ্যান্টের উপর। যে প্যান্ট পরে কাল সকালে আবার লোকটা ভাজতে বসবে কচুরী। আবার গল্প জমবে। ভাঙবে। ভাসবে। মানুষ মানেই গল্প। আঁচের গল্প। ধোঁয়ার গল্প। ধোঁয়ায় চোখ কটকটিয়ে, চোখের কোল গড়ানো জলের গল্প।