উপেনবাবুর ডাক্তারী করতে যত না ভালো লাগে, তার চাইতে ঢের বেশি ভালো লাগে নিজেকে ডাক্তার ভাবতে। হাসনাবাদের থেকে আরো ভিতরের দিকে এগোলে এই কেতুগ্রাম। অ্যালোপ্যাথি ডাক্তার বলতে এই উপেনবাবুই। বাবা ছিলেন কবিরাজ। বিশাল নামডাক। গোটা চারেক পুকুর, তিন-চারটে আমবাগান, দোতলা পাকা বাড়ি, সে একেবারে বিশাল ব্যাপার। উপেনবাবু এখন ওনার স্ত্রী মণিকা আর দুই ছেলে হরেন আর নরেনকে নিয়ে সংসার করছেন। সুখের সংসার। সচ্ছল অবস্থা। বাজারের মধ্যেই উপেনবাবুর চেম্বার। হাসনাবাদ রোডের ধারেই একদম। সারাটা দিন বাস লরি চলছেই।
আজ উপেনবাবু চেম্বার খুলেছেন এগারোটার পর। এমনিতে দশটায় খুলে ফেলেন। মণিকার জ্বর দু'দিন হল, আজ আবার বৃহস্পতিবার, তাই লক্ষ্মীপূজোটা সেরে আসতে দেরী হয়ে গেল। শীতকাল। রুগী তেমন খুব একটা হয় না এই সময়ে। তাই অত চাপ থাকে না। অবশ্য অত চাপ নেনও না উপেনবাবু। একটু ঘাঁটা কেস দেখলেই সদর হাসপাতালে রেফার করে দেন। উপেনবাবু দরজা খুলতে খুলতেই দেখলেন চারজন বসে। তিনজনকে চেনেন, এক বলাইয়ের মা, অম্বলের রুগী। দুই, বিশুদা, অর্শের সমস্যা। তিন, পল্টু, গোপন রোগ। চারজনটা কে? এই গ্রামের তো নয়, একেবারে আনকোরা মুখ দেখলে একটু নার্ভাস লাগে উপেনবাবুর। বয়েস চুয়ান্ন উপেনবাবুর, তবু ভয় ভয় ভাবটা ততটা গেল না।
যা হোক, একে একে তিনজনকে ছেড়ে চতুর্থজনকে ডাকলেন। লোকটার বয়েস আন্দাজ পঞ্চাশ হবে। টাকমাথা। পরনে হলুদ জামা আর খাকি প্যান্ট। অবস্থা খুব সচ্ছল না বোঝা যাচ্ছে। মাথায় যে ক'টা চুল তাতে ডাই করা। কম দামি ডাই, টাকেও কালো ছোপ ছোপ পড়েছে। তবে কি স্কিনের জন্যে? লোকটা সামনের চেয়ারে বসল। বলল, "আমার নাম বিলু, হাসনাবাদে একটা কারখানায় কাজ করি। পেটটা খুব কামড়াচ্ছে কাল থেকে। বমিও পাচ্ছে।"
উপেনবাবু পেটে হাত দিয়ে চাপ দিলেন, লোকটা 'উফ্' বলে উঠল। জিভ দেখলেন, সাদা দাগ পড়ে। 'হুম... ইনফেকশান...', মনে মনে বললেন। প্রেস্ক্রিপশান হাতে নিয়ে বললেন, বয়েস?
লোকটা বলল, "চল্লিশ।" "অ্যাঁ!", আচমকাই বেরিয়ে এলো উপেনবাবুর মুখ থেকে। লোকটা বলল, "হুম, আমাদের বংশের এই সমস্যা ডাক্তারবাবু, সবার পেটের ব্যামো। আর তাতে ভুগে ভুগে সবার বয়েস বেশি বেশি লাগে। আমার দাদু মারা যান একচল্লিশে, টাইফয়েডে, বয়েস যেন মনে হচ্ছিল ষাটের উপরে। বাবা গেলেন, ছেচল্লিশ, মনে হচ্ছিল সাতের ঘরে। আর আমাকে তো দেখছেনই। আমাদের পরিবারের কেউ পঞ্চাশ পেরোয়নি ডাক্তারবাবু", বলে লোকটা উদাস হয়ে চেম্বারের বাইরে তাকালো জানলা দিয়ে। উপেনবাবুও তাকালেন, বাইরে দুটো গরু চরছে। ওদুটো নিমাইদের গরু। বাইরে বেশ রোদ। ঠাণ্ডাটাও বেশ আজ, আচ্ছা লোকটা গরম কিছু পরে নি কেন?
- আপনার ঠাণ্ডা লাগছে না?
- না, মাটির গাড়ি নিয়ে এসেছি আপনাদের গ্রামে কারখানা থেকে। মাটি কাটা হচ্ছে। আমিও কাটছিলাম। হঠাৎটা পেটের ব্যাথাটা মোচড় দিয়ে উঠল, সবাই বলল, আপনি এখানে বসেন... তাই গামছা ফেলে এই জামা প্যান্ট পরে...
উপেনবাবু থামিয়ে দিয়ে বললেন, "আচ্ছা আচ্ছা।" বলে প্রেস্ক্রিপশান লিখলেন। অ্যান্টিবায়োটিক, পেটব্যাথার ওষুধ, বমির ওষুধ, মাথা ধরার ওষুধ, যদি জ্বর আসে ত্রাসে তবে জ্বর কমার ওষুধ, ল্যাক্টোব্যাসিলাস, আরো না কমলে মল পরীক্ষা, তাও না কমলে কোলোনোস্কপি, বমি তাতেও না কমলে এন্ডোস্কপি। প্রেস্ক্রিপশান প্রায় ভরে এলো যখন, একদম শেষে লিখলেন, সবেতে না কমলে সদর হাসপাতাল।
লোকটা চলে গেল। উপেনবাবুর ফিজ দেড়শো টাকা। গ্রামের অতিথি বলে নিলেন একশো। উপেনবাবুর চেম্বার ফাঁকা। বৃহস্পতিবার বাজার বন্ধ, রাস্তাঘাট ফাঁকা। উপেনবাবু চেয়ারে এলিয়ে বসলেন, চোখটা বন্ধ করলেন। এবার তিনি ভাববেন। কত কি। নানান দেশ থেকে রুগীরা তার কাছে ভিড় করে আসছে। সব জায়গা থেকে রেফারড রুগীরা ভিড় করে তার চেম্বার। উপেনবাবুর খুব ইচ্ছা একজন কম্পাউণ্ডার রাখেন। সে যে কবে হবে! উনি আরো ভাববেন, বিদেশ থেকে তাকে সম্মানিত করা হচ্ছে।
- আসব?
চোখ খুলে দেখেন গ্রামের প্রাথমিক স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত হেডস্যার ফ্যালা মাষ্টার। মানুষটাকে খুব শ্রদ্ধা করেন উপেনবাবু। প্রচুর জনহিতকর কাজ করেন উনি। উপেনবাবু উঠে দাঁড়িয়ে একগাল হেসে বললেন, "আরে আসুন আসুন, বসুন।" ফ্যালাবাবু বসলেন। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, "মেয়েটার বিয়ে বুঝলে, তা ওর হবু শ্বশুরবাড়ি থেকে কি সব রক্ত পরীক্ষা করতে পাঠিয়েছে, তুমি দেখো তো, এগুলো তুমি করে দিতে পারবে? ফ্যালাবাবু একটা চিরকুট উপেনবাবুর হাতে দিলেন। উপেনবাবু হাতে নিয়ে দেখলেন, HIV, Hepatitis B, Hepatitis C, Thalasemia, Thyroid. Sugar, Urea creatinin, অ্যালার্জি।
উপেনবাবুর কান মাথা গরম হতে লাগল, প্রথম কয়েকটা টেস্ট তাও করে অনেকে, তা বলে অ্যাত্তোগুলো? একি গরু, কুকুর কিনছে নাকি, যে ব্রীড টেস্ট করবে? ফ্যালাবাবু উপেনবাবুর মুখচোখের চেহারা দেখে কিছু একটা আন্দাজ করলেন, বললেন, "খুব কি খরচ হবে উপেন? বুঝতেই পারছো, এমন কি আর আমার রোজগার ছিল, তাই সঞ্চয় বলতে তেমন কিছু নেই। যা ছিল তা তোমার বৌদির চিকিৎসায় চলে গেছে সব, তাও যদি ফেরাতে পারতাম (ওনার স্ত্রীর ওভারিয়ান ক্যানসার হয়েছিল)।" ফ্যালা মাষ্টারের চোখে জল, গলা ধরে এলো।
উপেনবাবুর রাগে কানের ভিতরটা এখনো দপদপ করছে। এরা কি মানুষ? তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, "ছেলে কি কাজ করে?"
ফ্যালাবাবু বললেন, "হাসনাবাদে একটা কারখানা আছে। ওদের গাড়ি আসে আমাদের গ্রামে মাটি কাটতে। তো কুমারেশ, মানে ছেলে একবার এসেছিল, সে আমাদের কাকলীকে রাস্তায় দেখে, সেই পছন্দ হয়। তো তেমন দেনা-পাওনা কিছু নেই, শুধু একটা বুলেট আর চার বোনকে চারটে ওয়াশিং মেশিন কিনে দিতে বলেছে। তা ঠিক করলাম, আমাদের যে জমিটা আছে ওটা বেচে যা টাকা পাব তা দিয়ে এইসব হয়ে যাবে, তারপর ওর বিয়ে হয়ে গেলে একটা ভাড়া বাড়িতে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেবোখন।"
উপেনবাবুর আবার মাথা গরম হয়ে গেল। তিনি বললেন, "আপনি কাল আসুন।" ফ্যালা মাষ্টার চলে যেতেই উপেনবাবু চেম্বার বন্ধ করে দীঘির পশ্চিমপাড়ের দিকে ছুটলেন। মাটি কাটা হচ্ছে। ওই তো বিলু। গামছা পরে। তিনি তার পাশে দাঁড়াতেই সে চমকে উঠে কোদাল ফেলে দিয়ে বলল, "কি হল ডাক্তারবাবু?"
আমার সাথে একবার এসো দেখিনি, উপেনবাবু নিজের গলার আওয়াজ নিজেই এই সময়টায় চিনতে পারেন না। লোকটা পিছন পিছন এলো। উপেনবাবু তাকে একটা বাঁশবাগানে নিয়ে এলেন। কি ভাবে কথা শুরু করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। কি মনে হল, পকেট থেকে মানিব্যাগটা বার করে তার থেকে একটা পাঁচশ টাকা বার করে বললেন, "আমার খুব বিপদ ভাই, যদি উপকার করো...", বলে ওর মাটি লাগা হাতটা জাপটে ধরলেন।
লোকটা হতভম্ব হয়ে বলল, "কি হয়েছে ডাক্তারবাবু?"
- তোমার মালিকের নাম কি?
- পরেশ মণ্ডল
- কত বয়েস?
- আশি হবে
- ব্যবসা কে দেখে?
- ওর ছেলে কুমারেশ
উপেনের মাথার ভিতর আগুনের হল্কা খেলে গেল।
- কেমন চরিত্রের?
- কেন বাবু?
- যা জিজ্ঞাসা করছি বলো, আরো টাকা চাও তো দেব, বলো... একটা মেয়ের প্রাণ তোমার হাতে বিলু।
বিলুর মুখটা পাল্টে গেল হঠাৎ। সে গম্ভীর হয়ে বলল, "বিয়ে দেবেন না। ওর আগের বৌটা নিরুদ্দেশ। লোকে বলে খুন করে ওদের বাড়ির পিছনের শিব মন্দিরের তলায় পোঁতা। মেদিনীপুরে বাড়ি ছিল নাকি, প্রচুর জমি জায়গা ছিল। সব খেয়েছে এরা।"
উপেনবাবু বললেন, "ঠিক আছে", বলেই ফিরতে যাবে, এমন সময় বিলু ডাকল। উপেনবাবু ফিরে তাকালেন, বিলু টাকাটা তার হাতে দিয়ে বলল, "এ কাজের জন্য টাকা নিলে ধম্মে সইবে না, আপনার মেয়ে?"
উপেনবাবু বললেন, "আমার মেয়ে না, তার থেকেও বেশি..."
বিলু বলল, "টাকাটা আপনি রাখেন, আমি এমনিও বা আর ক'দিন..."
উপেনবাবু বললেন, "তোমার কোলাইটিস আছে বিলু, মরবে না।"
চমকে উঠলেন উপেনবাবু নিজের কথা শুনে নিজের কানেই। এই প্রথম এত স্বচ্ছ কোনো রোগের জড় খুঁজে পেলেন... কি করে পেলেন? নাহ্, কোনো সংশয়ও তো হচ্ছে না। একটুও ভয় করছে না। ফিরে বিলুর কাঁধে হাত রেখে বললেন, "তুমি অনেক বছর বাঁচবে আমার গ্যারেন্টি!"
উপেনবাবু ফ্যালা মাষ্টারের বাড়ি গেলেন। তাকে বোঝালেন। বাড়ি ফিরে, হারানকে ডেকে পাঠালেন। হারান ঘরে ঢুকতেই একটা ঠাঁটিয়ে চড় মারলেন। বললেন, "মুরোদ নেই তো প্রেম করতে যাও কেন?"
- আমি বলতাম, কিন্তু এই বছরও তো স্কুল সার্ভিস হল না …
- তা বলে কি মেয়েটা খুন হয়ে মরবে?
হারান কিছুই বুঝতে পারছে না। সে বাবার এ রূপ আগে দেখেনি। তার মা জ্বর গায়ে উঠে এসে জিজ্ঞাসা করল... "কি হচ্ছে গো?"
- তোমার ছেলেকে বলো টিউশানটা মন দিয়ে করতে... হারামজাদা মুরোদ নেই স্বপ্নকে সার্থক করার তবু স্বপ্ন দেখাবে। মুরোদ না থাকলে স্বপ্ন দেখা আর দেখানো দুই পাপ রে... এই দেখ আমাকে... আজ এত বছরে এসে জানলাম আমার বুদ্ধি কম ছিল না রে... সাহস ছিল না... আত্মবিশ্বাস ছিল না...।
উপেনবাবু হারানকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন, "মেয়েটাকে বাঁচা বাপ, ভেসে যাবে না তো..."
উপেনবাবু কাঁদলেন, হারান হারানের মা কাঁদলেন, কাজের পিসি বুলা কাঁদল... ফ্যালা মাষ্টার কাঁদল... শুধু কাঁদল না কাকলী... তার কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না... এমনও হয়... কুমারেশের কথায় সে রাজী হয়েছিল। সে কি লোভে? না না, সে হারানের অবস্থা চোখে দেখতে পারছিল না আর। ছেলেটার তার জন্য নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে চাকরী খুঁজে মরছিল। এদিকে ছোটোবেলা থেকে ওর ইচ্ছা শিক্ষকতা করবে, তাও গ্রামের স্কুলে। শুধু কাকলীর বয়েস হয়ে যাচ্ছিল দেখে সে নিজের শখ জলাঞ্জলি দিতে বসেছিল। ছিঃ ছিঃ, কাকলী সারাটা জীবন ওর চোখে চোখ রাখতে পারত? তাই তো সে ওই জানোয়ারটার কথায় রাজী হয়েছিল, শুধু হারানের স্বপ্নকে বাঁচাবে বলে। সেই সুযোগে শয়তানটা..... তার বুকে আঁচড়ের দাগটা মেলায়নি এখনও, হারান কি কিছু বলবে? তার মন বলছে কিচ্ছু বলবে না, সে ভালোবাসে... আর বললে বিষ খাবে সে...
আজ পাঁচ বছর হয়ে গেছে এই সবের। কেউ বিষ খায়নি। কুমারেশ জেলে। আর বিলুও বেঁচে এখনো, তার কোলাইটিস সেরে গেছে। তাকে দেখলে এখন চল্লিশের কম মনে হয়। সে এখন উপেনবাবুর কম্পাউণ্ডার।
সৌরভ ভট্টাচার্য
11 March 2017