বহুকাল আগে কোনো এক গ্রামে এক প্রজা হঠাৎ করিয়া একটি স্বর্ণখনি আবিষ্কার করিয়া ফেলিল। হইয়াছিল কী, এক দ্বিপ্রহরে সে গাভী চরাইতে চরাইতে চৈত্রের দাবদাহ হইতে নিজেকে রক্ষা করিতে একটি প্রাচীন বটবৃক্ষের নীচে ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল। ঘুম যখন ভাঙিল চাহিয়া দেখে আঁধার হইতে আর বেশি দেরি নাই। আরো ভালো করিয়া চাহিয়া দেখিল তাহার গাভীগুলিও নাই।
এদিক ওদিক খুঁজিতে খুঁজিতে এক ঝোপের মধ্য হইতে গাভীদের ডাক শুনিতে পাইল। দ্রুতপদে ঝোপে প্রবেশ করিয়াই আকস্মিক এক গহ্বরে পড়িল। পড়িয়াই চমৎকৃত হইল, ইহা যে স্বর্ণখনি!
তার্কিক বলিবে, সেই অন্ধকারে সে উহা যে স্বর্ণখনি বুঝিল কী করিয়া?
ইহাতে একটি রহস্যের উন্মোচন দরকার। প্রকৃতি লোভীর চক্ষুতে একটা বিশেষ জ্যোতি দিয়া থাকেন। যাহাতে লাভের পথ স্পষ্ট দেখা যায়, বিপদের আশঙ্কা তুচ্ছ মনে হয়। ঈশ্বরের ভয় মায়া বলিয়া বোধ হয়। জ্ঞান জগতকে মায়া বলিয়া প্রতিপন্ন করিয়া থাকে, লোভ ঈশ্বরকে।
যাহা হউক, চকিতে তাহার বুদ্ধি খেলিয়া গেল, এই বার্তা রাজাকে দেওয়া আবশ্যক। তাহা হইলে সেও সুরক্ষিত থাকিবে, আর ইহা নির্বিঘ্নে ভোগও করিতে পারিবে।
========
ভাগ্য সহায় হইল। রাজদর্শনের জন্য বেগ পাইতে হইল না। সবটুকু খবর শুনিয়া রাজার চোখ চকচক করিয়া উঠিল। নিম্নস্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন, এ খবর আর কেহ জানে কি?
প্রজা হাত কচলাইয়া কহিল, আজ্ঞে আমার পাঁচটি গাভী জানে।
রাজা প্রজার রসবোধে আর বিষয়বুদ্ধিতে তুষ্ট হইয়া তৎক্ষনাৎ রত্নখচিত হারটি স্বকন্ঠ হইতে খুলিয়া প্রজার গলায় পরাইয়া বলিলেন, কেহ যেন জানিতে না পারে। গাভীদের দ্বারা স্বর্ণ উত্তোলন করাইবে রাতে। সব আসিবে আমার গোপনকোষে। উহা হইতে পাইবে তোমার মাসোহারা। পঞ্চাশ পুরুষ বসিয়া খাইতে পারো এমন ব্যবস্থা হইবে পাকা।
=======
বৎসরের পর বৎসর কাটিয়া যাইতে লাগিল। সব ঠিক চলিতেছিল। প্রজার ঔদ্ধত্য ক্রমে বাড়িতেছিল। রাজার নিকট নালিশও যাইতেছিল। রাজা হাসিয়া উহাকে অভিযুক্ত প্রজার বালখিল্য বলিয়া তুচ্ছ করিল আর অভিযোগকারীদের ক্ষুদ্রমতি, ঈর্ষাপরায়ণ বলিয়া কর বাড়াইয়া দিতে লাগিল। ফলে অভিযোগ আসা কমিতে লাগিল। ঔদ্ধত্য বাড়িতে লাগিল। স্বর্ণোত্তলনও বাড়িতে লাগিল।
==========
এমন সময় ঘটিল এক বিপদ। কী করিয়া ওই গহ্বরে জন্মিল এক পারিজাত বৃক্ষ। কেহ খেয়াল করে নাই। কিন্তু যখন পারিজাত ফুল ধরিল আর তাহার সৌরভ গ্রাম তো দূরের কথা রাজার নাইবার ঘর অবধি পৌঁছাইল, রাজা নাইতে নাইতেই ঘামিতে শুরু করিল।
উপায়? সবাই যে সব জানিয়া যাইবে!
রাজা প্রজা ও গাভীগুলির সঙ্গে পরামর্শ করিয়া সেই গাছের গোড়ায় বিষ দিল। বড় বড় ধারালো অস্ত্র লইয়া কাটিতে লাগিল। কিন্তু কিছুতেই কিছু হইল না। গাছ বাড়িয়াই চলিল, ফুল ফুটিতেই লাগিল, আর তাহার সৌরভে গ্রামের লোক এদিকে আসিতে লাগিল। তারা প্রায়ই খোঁজে আসিয়া, এ গন্ধের উৎস কি?
রাজার কাছে কথা লইয়া গ্রামের সকলে যাইল। রাজা পেয়াদা পাঠাইয়া মিছিমিছি সারাটা গ্রাম, জঙ্গল ঘুরাইয়া বলিল, উহা ভ্রম। আরো বলিল, “গ্রামের বাহিরে গভীর জঙ্গলে এক চাঁপাবৃক্ষ চাঁপা ফুলে ভরিয়া উঠিয়াছে, তাহারই সৌরভ ইহা”।
গ্রামের লোক মানিয়া লইল, কিন্তু বিশ্বাস করিল না।
=======
রাজা কহিল বিষ্ঠা ছড়াও চারপাশে। মৃত পশুর গলিত, শঠিত দেহাবশেষ ছড়াও এদিকে। যাহাতে কেহ টের না পায় পারিজাতের সুবাস।
তাহাই করা হইল। দুর্গন্ধের পর দুর্গন্ধের আয়োজন করা হইল। গ্রামের লোক অতিষ্ঠ হইয়া উঠিল। রাজার কাছে নালিশ করিল। রাজা কহিল উত্তম বৈদ্যের সন্ধান পাওয়া গেছে। তিনি আসিতেছেন। গ্রামের প্রজাদের নাসিকা কিছু অতিসক্রিয় হইয়াছে, চিকিৎসা করিয়া সারাইয়া দিবেন। ব্যয়ভার রাজার।
=======
চিকিৎসক আসিল। কিন্তু চিকিৎসায় ফল হইল বিরূপ। পূর্বে শুধু গন্ধ পাইত, এখন প্রতি রাতে কেহ না কেহ স্বপ্ন দেখিতে শুরু করিল এ গ্রামে একটি বড় সোনার খনি আছে। যাহার খবর জানে রাজা আর আর একজন প্রজা। সে খনিতে আছে একটি পারিজাত বৃক্ষ, যাহার সুবাসে আমোদিত গোটা গ্রাম।
খবর বিদ্যুৎ বেগে ছড়াইতে লাগিল। আশেপাশের গ্রামের লোকও জড়ো হইতে লাগিল। সবাই বলে উৎসটি কোথায়?
রাজার নিদ্রা উড়িয়া গেল। লোভী প্রজাটির নিদ্রা উড়িল। তাহারা অদ্ভুত আচরণ শুরু করিল। আচমকা রাজা জিজ্ঞাসা করিয়া বসে, এ দেশে কে রাজা? প্রজা আচমকা মশকী দেখিয়া রাক্ষস রাক্ষস করিয়া চিৎকার করিয়া ওঠে।
প্রজারা ঠিক করিল ইহাদের চিকিৎসার দরকার। সেই বৈদ্যকে আবার খবর দিল। বৈদ্য আসিল। কিন্তু রাজা কহিল বৈদ্যতে আমার কী দরকার? লোভী প্রজা কহিল, না জানি কোন মতলবে আসিয়াছে। রাজা কহিল ইহা শত্রুদেশের চক্রান্ত। লোভী প্রজা কহিল, আমাকে সরল পাইয়া পাগল বানাইবার তাল।
=========
তাহার পর কী হইল স্পষ্ট জানি না। শুনিয়াছি পারিজাত বৃক্ষটির চারা লইয়া প্রজারা বাড়ি বাড়ি লাগাইতেছে। স্বর্ণখনির দিকে চাহিয়া প্রজারা দেখিয়াছে শুধু কঙ্কাল আর রুধির মিশ্রিত মাংসপিণ্ড। রাজা আর লোভী প্রজা কী করিয়া ইহাকে স্বর্ণ মনে করিয়াছিল ভাবিয়া কূল পাইল না।
বৈদ্যকে সবাই জিজ্ঞাসা করিয়াছে, ইহাকে রাজা আর ওই মানুষটি সোনা বলে কেন?
বৈদ্য হাসিয়া বলিয়াছে, চোখের ভিতর লোভ ঢুকিলে মানুষ এমনই হইয়া যায়। অনেকক্ষণ আপনাকে বেড়িয়া ঘুরিলে যেমন জগৎ ঘুরিতেছে মনে হয়, লোভীর দৃষ্টিতে তেমনই হাতের তালুতেই হিমালয় ধরিবে সাধ যায়।