রমাকান্ত রাত্রের খাওয়া দাওয়া সেরে সবে ছাদে উঠেছে। রাত তখন এই পৌনে এগারোটা। মোবাইলে হেমন্ত'র গান বাজছে - 'বসে আছি পথ চেয়ে...' আহা! প্রাণটা জুড়িয়ে আসছে রমাকান্তর। ফুরফুরে হাওয়াও দিচ্ছে না সাথে! রমার খালি শ্যামার মুখটা মনে আসছে। তার স্ত্রী। তাকে ভবানীপুরের বাড়িটায় রেখে আসতে হল। তা হবে না ছেলেটার মাধ্যমিক যে!
সে এসেছে বাগনানে। তার বিধবা পিসির অনেক জমি জায়গা। পিসি'র এই গত পূজোর সময় একটা বড় ধরণের স্ট্রোক হল। কোনোরকমে প্রাণে বেঁচে ফিরেছেন। পিসি'র যিনি হাত দেখেন, তিনি বলেছেন সামনের বর্ষার আগে আরেকটা হওয়ার যোগ আছে। একে নাকি 'হৃদয় বিদারক যোগ' বলে। সেই থেকে পিসি'র বায়না, "আয় আয় রন্তু জমিটা তোকে লেখাপড়া করে দিয়ে যাই।" কারণ পিসির একমাত্র ছেলে অভিকান্ত সে মেয়ে পছন্দ হয়নি বলে ফুলশয্যার রাতে সেই যে ঘর ছেড়েছে আর বাইশ বছর হল তার দেখা নেই। কেউ কেউ বলে সে নাকি উড়িষ্যার কোন আদিবাসীকে বিয়ে করে সেখানেই চিরকালের জন্য আদিবাসী হয়ে গেছে। পিসি তার হাত ধরে সারাটা সকাল কেঁদেছে, "তুই অন্তু এলে ওর ভাগটা দিয়ে দিস বাছা, যদ্দিন না আসে তুই ভোগ করিস, কেমন!” রন্তু মানে রমাকান্ত মাথা নেড়েছে যতটা নাড়া সম্ভব আর কি স্পন্ডেলাইটিস সামলে। তা লেখাপড়া হতে আর দু-একদিন বাকি আছে। যিনি করাবেন তার গোরুটা নাকি সন্তানসম্ভবা, তাই সে এখন আসতে পারবে না। অগত্যা রমাকে থাকতেই হচ্ছে।
রমা ঘড়ি দেখল, এগারোটা কুড়ি। নীচে নামতে ইচ্ছা করছে না। এই জায়গাটা বেশ ফাঁকা, চারদিকে সবুজ, গাছগাছালিতে ভরা। 'আঃ...' রমা খুব গভীর একটা শ্বাস নিয়ে ছাদের কার্ণিসে ভর দিয়ে দাঁড়াল। সামনের নারকেল গাছটার মাথা দিয়ে চাঁদ উঠেছে। রমা গাইছে, 'নারকেল গাছের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই...' হঠাৎ পাশ থেকে কে যেন বলল, "আরে ওটা বাঁশ বাগানের মাথার উপর হবে রে রমা..."
রমাকান্ত চমকে উঠল। পিছনে ঘুরে দেখে কেউ নেই। গা'টা ছমছম করে উঠল। আবার কে বলে উঠল, "দেখবি কি করে রে বোকা... আমার কি শরীর আছে নাকি তোর মত?"
রমার শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠান্ডা কি নেমে গেল। দাঁতে দাঁতে ঠোকাঠুকি লাগার জোগাড়।
অন্ধকার থেকে আওয়াজ এলো, "ঠিক আছে তুই সামলে নে, আমি বসছি।"
নিস্তব্ধ চারদিক। শুধু ঝিঁঝিঁর ডাক চারদিকে। রমা কুলকুল করে ঘামছে। অন্ধকার থেকে গান ভেসে আসছে, 'ভজো মন রামচরণ সুখদায়ী...'
রমা কিছুটা সামলে নিয়ে বলল, "আ আ আপনি কে? মানে... কি চান...?"
"এই তো কথা ফুটেছে। আমি হলুম গিয়ে তোর পিসেমশায়ের ঠাকুরদার বাবার বন্ধু। অপঘাতে মৃত্যু হয়েছিল। সাপের কামড়ে। সেই থেকে ওই বটগাছটা হয়ে আছি।"
রমা চমকে দক্ষিণ দিকে তাকালো। তাই তো! বটগাছটা কই? ফাঁকা যে! রমার এবার কান্না পাচ্ছে।
অন্ধকার বলল, "তোর সাথে কিছু কথা আছে বুঝলি? তা আজ শুনবি না একদিন বিশ্রাম নিয়ে শুনবি। তোরা এই যুগের ছেলে, ভূত তো তেমন বড় একটা দেখতেই পাস না, তা আক্কেল গুড়ুম তো হবেই বাছা প্রথমবার দেখলে, কি বলো নিমাইয়ের মা?"
একটা নারীকণ্ঠ ভেসে এল, "তা তো বটেই।"
বট ভূত আবার বলতে লাগল, "সেকালে ভূতেদের সঙ্গে মনিস্যিদের ফুটবল ম্যাচ হত জ্যোৎস্না রাতে। এত কাজের লোক ছিল কোথায়? ভূতেরাই তো ব্যাগার খাটত। তা সরকার থেকে আইন করল ভূতেদের আর কাজে রাখা যাবে না। সেই থেকে না..."
রমার হুঁশ ওড়বার যোগাড়।
অন্ধকার বলল, "ও তোমাদের ওই সজনে গাছটা গো, পুকুরের পূবপাড়ে। বড় দুঃখী মেয়ে। মাত্র ঊনষাট বছরে গলায় দড়ি দিল। ছেলে মুসলমান মেয়ে বিয়ে করেছে বলে। এখন মাগী পস্তাচ্ছে। মরে দেখছে, মরলে কেউ হিঁদু, মুসলমান, খেষ্টান হয় না... বোকা মেয়ে..."
একটা ফোঁপানি কান্না ভেসে এলো। নিমাইয়ের মা, মানে সজনে গাছ কাঁদছে।
"দেখো রমা, তুমি লোক ভাল। তোমাদের কলকাতার বাড়ির সামনে যে কাঁঠাল গাছটা আছে, সে হল আমার খুড়শ্বশুরের শালা, মাল একটা", সে বলল, "তা সে চট করে কারো প্রশংসা তো করে না। মরলও সে দোষেই। বউয়ের বাপের বাড়ি তুলে রোজ গাল পাড়ত। তা একদিন বউ দিল শিলনোড়া দিয়ে বেটে।"
"কি বেটে দিল গো দাদা?" মহিলা ভুতের থুড়ি সজনে পেত্নীর প্রশ্ন।
"তুমি থামো নিমায়ের মা। ও তুমি বুঝবানানে। সে বড় গুহ্যকথা।"
রমা হঠাৎ খেয়াল করল সে ঘামছে না। সে বলল, "কি বলবেন যেন বলছিলেন?"
বটদেহী বলে উঠল, "আহা এই তো বাছার আমার সাহস ফিরেছে। আসলে বলছিলাম কি, এই জমি তো তোমার হতে চলেছে। তা তুমি সব বেচেবুচে ফ্যালাট বানাবার মতলব করবে না তো? অথবা অন্য কাউকে বেচে দিলে, সে হয় তো ওই সব ফন্দী আঁটল। আমরা সেই কবে থেকে আছি বলো। আমরা কই যাই? কি বলো কাত্তিক? আরে নেমে এসো, বলেছিলাম না, এ আমার লোক ভালো।"
এরপর রমা যা দেখল তাতে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। সামনের নারকেল গাছটা, হঠাৎ পাতাগুলো গুটিয়ে দিব্যি একটা ঢ্যাঙা লোক হয়ে তিন চারটে পা ফেলে তার সামনে এসে হাজির।
রমা গুটিয়ে বসে পড়ল ছাদের এক কোণায়। তারপর এদিক ওদিক থেকে, পেয়ারা, জামরুল, জবা, অশ্বত্থ, সব এক এক মূর্তি ধরে সামনে এসে বসে পড়ল তার।
তারপর সে কি কাকুতি মিনতি, "ও দাদা, ও ভাই, ও বাছা, ও খোকা..."
সে দেখল একটা গোলাপ গাছ চুপ করে বসে আছে। কথা বলছে না। রমা তার দিকে তাকাতেই সে বলল, "আমি ফুলি গো।" রমা চমকে উঠল। তার ছোটবেলার খেলার সাথী। পুকুরে ডুবে মারা গিয়েছিল শুনেছিল। সে উঠে গিয়ে তাকে ছুঁল। কাঁটা বিঁধল, তবু লাগল না।
সে কিছু বলতে যাবে এমন সময় পিসি হাজির। পিসি এসেই চীৎকার করে উঠল, "আমি দেরি হচ্ছে দেখেই বুঝেছি, ব্যাটাগুলো ধরেছে তোকে।"
রমাকান্ত তো হাঁ, "মানে তুমি জানতে?"
পিসি বলল, "জানতুম মানে? আমিও তো জানলাম এই গেল সপ্তাহে। বাবুর খোঁজ নিতে লুকিয়ে লুকিয়ে উড়িষ্যার দিকে রওনা দিলুম। তা পথের মধ্যেই হার্ট অ্যাটাক। কে আর আমায় চেনে সেখানে বল, তাই দিল পুড়িয়ে। তারপরই তো এই সব। ওরাই তো তোকে চিঠি লিখে আনাল।"
রমা আবার ঘামছে।
পরের ঘটনা। রমা কলকাতায় ফিরে আসার পর ধুম জ্বর। ডাক্তার রোগ ধরতে পারল না। জ্বর সারল দশ দিনের মাথায়। সে পিসিবাড়িতে একটা বড় নার্সারী খুলেছে। সেখানে নানান রকম গাছ (মানে নানান রকম ভূত আর কি!)। আর খুব বলেকয়ে বাড়ির সামনের কাঁঠাল গাছটাকে রাজী করিয়ে সে বাগানে পাঠানো গেছে। শুধু ভূত বলেই অবিশ্যি তা সম্ভব হয়েছে !
(ছবিঃ সুমন)