সৌরভ ভট্টাচার্য
14 June 2020
১
=====
জি এন দাস। পুরো নামটা মনে নেই। রামকৃষ্ণ মিশনের এককালীন অধ্যক্ষ স্বামী রঙ্গনাথানন্দজীর মন্ত্রশিষ্য ছিলেন। সেই দাস মহাশয়ের জীবনে তখন তুমুল দুর্যোগ। ব্যবসায়, ব্যক্তিগত জীবনে, বন্ধুবান্ধব মহলে, এমনকি নিজের স্বাস্থ্যের দিক থেকেও। চিঠি লিখলেন স্বামী রঙ্গনাথানন্দজীকে, দেখা করতে চান। কথা বলতে চান। চিঠির উত্তর এলো। সময় পেলেন দেখা করার। নির্দিষ্ট সময়ে দাস মহাশয় পৌঁছালেন স্বামীজীর ঘরে।
বিরাট হলঘর। বড় একটা টেবিলের একধারে স্বামী রঙ্গনাথানন্দজী বসে। দাস মহাশয় ঢুকলেন। মহারাজজী জিজ্ঞাসা করলেন, কি হয়েছে?
শ্রোতা মহারাজ। বক্তা দাস মহাশয়। সমস্ত কথা মন দিয়ে শোনার পর বেশ কিছুক্ষণ গল্প করলেন মহারাজ --- ঠাকুরের নানান গল্প, স্বামীজী, মায়ের কিছু গল্প ইত্যাদি। দাসের মন ধীরে ধীরে হালকা হচ্ছে শুনতে শুনতে। সময় শেষ। দাস মহাশয় উঠলেন, মহারাজকে প্রণাম করে দরজার কাছে আসলেন, হঠাৎ মহারাজ ডাকলেন, দাস...
দাস মহাশয় ফিরে তাকালেন। মহারাজ সস্নেহে, গভীর ভালোবাসায় তার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ঠাকুরের ওই কথাটা সব সময় মনে রাখবেন, "থাক শালা 'আমি' দাস হয়ে"। মন্ত্র কি শুধু সংস্কৃতেই হয়? এও মন্ত্র, মনে রাখবেন। আবৃত্তি করবেন মনে মনে। যে অবস্থাতেই থাকুন না কেন, মনটাকে তাঁর দাস করে ফেলুন। সব ঝড়ঝাপটা সামলে যাবে। সেই যে বেড়ালের ছানা, মা যেখানেই রাখেন, সে শুধু মিউ মিউ করে। হেঁশেলেই রাখুন আর শোয়ার ঘরে বিছানার উপরেই রাখুন।
দাস মহাশয় ফিরে আসছেন। মাথায় ঠাকুরের কথাগুলো। মহারাজের প্রসন্ন হাসি। পরে লিখেছিলেন, সেইদিনের সেই কথাগুলোই তাকে লড়াইয়ের শক্তি ফিরিয়ে দিয়েছিল, নইলে রাতদিন তার মাথায় নাকি আত্মহত্যার চিন্তা ঘুরে ফিরে আসত।
২
===
যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত। একজন যুবক। চেন্নাইতে। তাকে ফাঁসানো হয়েছে। কারোর সাথে কথা বলতে চায় না। তবু একজন বন্ধু জেলে দেখা করতে আসে। তাকে আশ্বাস দেয়। ঠিক সে বিচার পাবে, এইসব বলে। তার ভালো লাগে না শুনতে। তবু সে রোজ বলে। জোর করে বলে।
একদিন সে ঠিক করল যা হোক, আজ যা বলে মন দিয়ে শুনবে। বন্ধুকে নিরাশ করবে না। কারণ আজ রাতে সে আত্মহত্যা করবে। জেলের মধ্যে কি করে আত্মহত্যা করবে সব স্থির করে ফেলেছে। তাই শেষবারের মত বন্ধু যা বলবে তাই শুনবে।
বন্ধু সেদিনও তাকে অনেক কিছু বলল। আশার কথা। তারপর যাওয়ার আগে একটা চটি বই দিয়ে গেল, সারদাদেবীর উক্তি। বইটা নিল। বন্ধু চলে গেল।
সন্ধ্যের পর কি মনে হল বইটা খুলে বসল। দু'পাতা পড়েই না হয় যা করার করবে। এতবার করে বন্ধুটা বলে গেল। সেই বইটাই তার জীবনের মোড় ঘোরালো। সারদা দেবী একটা জায়গায় কাউকে বলছেন, দেখো শরীর ধারণ করলেই হাজার একটা অশান্তি, দুঃখ ভোগ করতেই হবে। এই যেমন ধরো অবতারেরা, রাম, কৃষ্ণ, বুদ্ধ, চৈতন্য, খ্রীষ্ট কি নিদারুণ যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছে তাদের আজীবন। তাই ঠাকুর বলতেন, যে সয় সে রয়, যে না সয়, সে নাশ হয়।
সে যুবকের মনের গতি মুহূর্তে গেল ঘুরে। তার মনে হল তাই তো, ওরকম শুদ্ধজীবনের মানুষেরা যদি এমন যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে যেতে পারেন, তবে আমি নই কেন?
বছরের পর বছর গেল। মন শান্ত তার। জেলে ভালো ব্যবহারের জন্য সাজা কমে আসে। বাকি জীবনটা জেলে জেলে গিয়ে কয়েদীদের রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ, মা সারদার বাণী শুনিয়ে, কয়েদীদের সাথে কথা বলেই কাটে তার।
৩
====
একটা ঘোড়ার গাড়ি ছুটছে। একটা পরিবার। সন্তানেরা ও তাদের মা-বাবা। সংসারের পুরুষটি দীর্ঘদিন যাবৎ নানা অশান্তিতে, ব্যর্থতায় জেরবার। তিনি ঠিক করেছেন স্ত্রীকে সন্তানসহ তার বাপের বাড়ি রেখে আত্মহত্যা করবেন।
ঘোড়ার গাড়ির চাকা গেল ভেঙে মাঝপথে। কোথায় যাবেন? স্ত্রী-র এক আত্মীয়ের বাড়ি উঠলেন। আত্মহত্যার পরিকল্পনা স্থগিত হল আপাতত। বিকালে সেই পরিবারের একজনের সাথে এক মন্দিরে ঘুরতে এলেন। এখানে নাকি একজন সাধু থাকেন। দেখা করবে? আত্মীয় জিজ্ঞাসা করল।
দেখলেই হয়। দু'জন পুরুষ এলেন এক বন্ধ ঘরের সামনে। এক মহিলা বেরোলেন ঘর থেকে। সন্ধ্যে হয়ে গেছে। দূরে মন্দিরে আরতি শুরু হল। "উনি কি ধ্যানে বসেছেন?"
না না, দরজাটা ভেজানো, ধুনো দেওয়া হয়েছে। ঠেলুন, খুলে যাবে।
দরজা খুলে গেল একটু চাপ দিতেই। একটা ছোটো খাটে বসে এক পুরুষ - রামকৃষ্ণ। আত্মহত্যা সঙ্কল্পী মানুষ প্রণাম করলেন - মাষ্টার মহাশয়।
বাকিটা ইতিহাস।