দেরি ছিল আসার। বাঁধানো উঠানের ধারে দুটো কলাগাছ। তার পাশে একটা বড় জামগাছ। তাতে মৌচাক হয়েছে বেশ কয়েকমাস হল। খুব কথা বলত ছোটবেলা থেকে, তাই বাড়ির লোক নাম রেখেছিল, ফুলঝুরি। বর্ধমান থেকে কিছুটা ভিতরে এক অখ্যাত গ্রামে জন্ম ফুলঝুরির। এখন বয়স চৌষট্টির দোরগোড়ায়। শরীরে গড়ন বেশ মজবুত এখনো। চোদ্দ বছর বয়সে বিয়ে হয়ে এল রাণাঘাটে। এটা ২০১৪।
ফুলঝুরি নাতির সাথে খেলছে সকাল থেকে। এই সময়টা তার খুব ভাল লাগে। ভয় শুধু ওই মৌমাছির চাকে। কখন যে এসে কামড়ায় ছেলেটাকে। ফুলঝুরি সারাক্ষণ সতর্ক। এই ভিটেটা তার শ্বশুর মশায়ের কেনা, ওপার বাংলা থেকে এসে। ফুলঝুরি অবশ্য শুধু শাশুড়িকেই দেখেছে। খুব ভাল মানুষ ছিলেন।
ফুলঝুরি নাতির সাথে একটা বল নিয়ে খেলতে খেলতে আজ খালি অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছে। আজ তার আসার কথা। তার স্বামী, হরমোহনের।
ঘটনাটা ঘটে ফুলঝুরির গর্ভাবস্থাতেই। একদিন বিকালে তার স্বামী হরমোহন আর কাজ থেকে ফিরলেন না। কত খোঁজা হল। কেউ বললে হরিদ্বারে, কেউ বললে রামেশ্বরমে, কেউ বললে কেদারবদ্রীতে দেখেছে তার স্বামীকে। সন্ন্যাসী নাকি এখন সে। কেউ বলে, সদরের একটা ছুঁড়ির সাথে নাকি লক্ষ্ণৌতে পালিয়েছে। কেউ বলে গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়েছে, কেউ বলে রেলে গলা দিয়েছে।
এসব শুনতে শুনতে ফুলঝুরির এতগুলো বছর কেটে গেল। মনের বাইরেটা কড়া পড়ার মত অনুভুতিহীন। কিন্তু ভিতরটা পাকা ফোঁড়ার মত টনটনায় আজও মাঝে মাঝে।
সেদিন হঠাৎ একটা চিঠি এল। সে পড়তে পারে না। বাবু (তার ছেলে) আসলে পড়বে বলে রেখে দিল। চিঠিটা যখন শুনল ফুলঝুরি প্রথম কয়েক ঘন্টা কিছু বুঝলই না, তার কি লাগছে। স্বামী ফিরছে।
এত বছর পর! সব মানুষ একা থাকতে পারে না। মনের তাও বুঝ্ আছে কিন্তু শরীর! সে তো যুক্তি মানে না। ফুলঝুরির শরীরও মানে নি। দু'পাড়া পরেই গোবিন্দের বাড়ি। রাজমিস্ত্রীর কাজ করে। সেই যেবারে খুব বন্যা হল। গোবিন্দ এসেছিল তার বাড়ির ছাদ সারাতে। তখন ফুলঝুরির ভরা যৌবন। বন্যায় ভাসল সব।
গোবিন্দ বিয়ে করল না সারা জীবন। ফুলঝুরিকেই চেয়েছিল। ফুলঝুরি রাজী হয়নি, বড় হয়ে ছেলেকে কি বলবে?
আজ সকালেও গোবিন্দ বসে আছে ফুলঝুরির উঠানে রোজকারের মত। চা খেতে আসে রোজ এ সময়টা। ফুলঝুরির মুখের দিকে আড়চোখে দেখছে গোবিন্দ মাঝে মাঝে। খুব অবাক লাগে গোবিন্দর, আজও ফুলঝুরির মুখের দিকে তাকালেই তার চোখে একটা মায়া জড়িয়ে আসে। ঝোলাগুড়ের মত মিষ্টি লাগে মনটা। কোথাও একটু টাটায়ও অবিশ্যি। গোবিন্দ জানে আজ হরমোহন ফিরবে। কি পেল সে নিজে সারাজীবন? "হে ঠাকুর, কি নিষ্ঠুর তোমার বিচার! সোহাগ ভালবাসা কি কিছুই তার ভাগ্গে নাই? সে তো আর কিচ্ছু চায়নি সারাজীবন। শুধু ফুলঝুরির কাছে কাছে থাকা! এও পাপ, এও তোমার দিতি মন সরল না?"
তার বুকের ভিতরটা মশলা মাখার যন্ত্রের মত কড় কড় আওয়াজ করেই যাচ্ছে। চোখে জল চলে আসছে থেকে থেকেই।
ফুলঝুরি গোবিন্দের দিকে তাকাতে পারে না সংবাদটা আসার পর থেকেই। চিঠিটা যেন দুফালা করে দিয়েছে সব। সে কার জন্য বেঁচে আছে এতটা কাল? হে ঠাকুর, আমি যে দুটুকরো হয়ে গেলাম। গলায় দড়িই দিতাম, কিন্তু নাতিটার মুখের দিকে তাকালে যে বাঁচতে সাধ যায়!
ফুলঝুরির মাথা ঝাঁ ঝাঁ করে যাচ্ছে! পাগল পাগল হয়ে যাচ্ছে। মাথার মধ্যে যেন মস্ত মৌচাক। কালবৈশাখীর মত মাতাল হয়ে গেছে তার চিন্তা ভাবনা।
হঠাৎ তার কি হল। উঠে গিয়ে গোবিন্দের দিকে তাকিয়ে চীৎকার করে গালাগাল করতে শুরু করে দিল। গোবিন্দ হকচকিয়ে কেঁপে উঠল ফুলঝুরির আচমকা আক্রমণে।
"তোমাকে কতদিন বলেছি এভাবে সক্কালবেলা এসে এখানে বসে থেকোনি, নিজির সংসার নেই বলে কি কারোরই নেই! আচ্ছা জ্বালা হল আমার, রোজ সকালে কি এখানে না মরলেই নয়....."
আরো কিসব বলে যাচ্ছে ফুলঝুরি। তার মানে না বুঝছিল ফুলঝুরি নিজে, না গোবিন্দ। গোবিন্দ আসতে আসতে উঠে দাঁড়াল। তার মাথা কান গরম হয়ে গেছে।
ফুলঝুরি থর থর করে কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়ল। হাউ হাউ করে কাঁদছে। কেন কাঁদছে!
চীৎকারে কয়েকজন লোক জড়ো হয়েছিল পাড়ার। প্রবীণরা কিছু বুঝল, ঠোঁটের কোণে হাসি দেখা গেল, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ-করূণা মেশানো অর্থবহ সে হাসি। নবীনদের চোখে কৌতুক।
কয়েকটা মৌমাছি পুরো বাড়িটাকে ঘিরে ঘিরে উড়তে লাগল।
(ছবিঃ সুমন দাস)