Skip to main content

        মুরাদের নোবেল প্রাইজ পাওয়ার পর থেকে অনেক পোস্ট দেখলাম। অনেকগুলো সাক্ষাৎকার যা আগে শুনেছি কয়েকটা, লাস্ট গার্ল বেরোনোর সময় বিশেষ করে। রিভিউও পড়েছিলাম বইটার। কিন্তু বইটা পড়ে ওঠা হয়নি। কিন্ডল-এ আছে, কিন্তু সাহস পাইনি পড়ার। একটা নিশ্চিত জীবনযাপনের মধ্যে বসে অমন একটা বই পড়ার যোগ্যতা আছে কিনা মনে প্রশ্ন এসেছে বারবার, কিছুটা বিলাসিতা হয়ে যাবে না তো? কারণ সাক্ষাৎকারগুলো শুনতে শুনতেই অসুস্থ বোধ করেছি, মাঝখানে থামিয়ে হাঁটতে চলে গেছি, ফিরে এসে আবার বাকিটা শুনেছি। 
        কিন্তু এখন সেই কথা বলতে চাইছি না। যেদিন মুরদা নোবেল পেলেন, সেদিন থেকে আমার মন সদ্য স্বাধীন ভারতের দিল্লী-বম্বে আর কলকাতার গণিকাপাড়ায় আটকে। ১৯৪৭ সাল, ভরে যাচ্ছে গণিকালয়গুলো উদ্‌বাস্তু মহিলাতে। তাদের কাউকে পরিবার থেকে তুলে আনা হয়েছে, মাঝপথে পরিবার থেকে ছিন্ন করে নিয়ে লাগাতার ধর্ষণ করা হয়েছে, আরো আরো বর্ণনাতীত অত্যাচার। 
        আমার মনে আছে একটা ঘটনা নিজের কানে শোনা। তখন রেলকলোনীতে থাকি। একজন বয়স্কা মহিলা কাজ করতেন আমাদের বাড়ি। বাংলাদেশে বাড়ি ছিল। দেশভাগের সময় তার ছেলেকে তার সামনে কোপানো হয়, তার বউমাকে তার সামনে ধর্ষণ করা হয়, তারপর তাকে। তার নাতি তখন এক বছরের। তারপর সারারাত লুকিয়ে হেঁটে, পেঁপের ডাল মুখে নিয়ে জলের তলায় চুবে, এক প্রকার উলঙ্গ হয়ে এদেশে পৌঁছায়। 
        সে যখন কথাগুলো মাকে বলত আমি পড়ার ঘর থেকে শুনতাম, তারপর তার সেই বউমা বা তার জোয়ান নাতি যখন কোনো কাজে আমাদের বাড়ি আসত আমি অপরাধীর মত মুখ লুকাবার চেষ্টা করতাম। আমার কেন অপরাধ লাগত আমি জানি না। হয়ত নিজের মনের মধ্যে একটা নিরপরাধ, সুন্দর, সাদা ধবধবে চাদরের মত জগতের ভাব পোষণ করতাম বলে কিনা জানি না, নাকি নিজের নিরাপদ সুখী জীবনটাকে নিয়ে সঙ্কোচে পড়তাম তাও জানি না। কিন্তু কিছু একটা হত, আজও হয়, একটা ভাষাহীন অস্থিরতা। 
        হিন্দু, মুসলমান, শিখ তাদের বিধর্মী মেয়েদের তুলে নিয়ে যাচ্ছে, চূড়ান্ত অত্যাচারিত হচ্ছে তারা। চৈতরাম গিদোয়ানি, তখনকার দিনের প্রমুখ কংগ্রেস রাজনীতিবিদ বলছেন, 'আর কোনো যুদ্ধে মেয়েদের এমন নির্যাতন হয়নি হয় তো।' সে বলতে পারি না, তবে যা হয়েছিল তা একটা সভ্যতার ইতিহাসের পক্ষে কলঙ্কের চাইতেও বেশি কিছু। মৃদুলা সারাভাই, রামেশ্বরী নেহেরু এনারা উঠে পড়ে লাগেন সেই নির্যাতিতা মহিলাদের পুনরুদ্ধারের জন্য। তাদের পরিবারের কাছে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু অনেকেই আর যেতে চান না, কারণ অনেকেই লাগাতার ধর্ষণে গর্ভবতী, কে নেবে সে জারজ সন্তানের ভার? আর যদি বা সে নাও গর্ভবতী হয়, তবু সে অসতী তো নিশ্চয়, হোক না কেন সে অনিচ্ছায়। তাই অনেকে যেতে চাইল না, অনেকে চিরকালের জন্য বেশ্যা হয়ে গেল, অনেকে বিষ খেল, গলায় দড়ি দিল, গায়ে আগুন দিল। 
        নেহেরু রেডিওতে ঘোষণা করছেন, আপনারা যেন মনে না করেন আপনাদের শুদ্ধতা নিয়ে আমাদের কোনো সংশয় আছে, আপনারা ফিরে আসুন, যেই হোন, যে অবস্থাতেই থাকুন, ফিরে আসুন। আপনাদের কোনো ভুল ছিল না, আপনারা শিকার হয়েছেন পরিস্থিতির। আপনাদের আন্তরিকতার সাথে, সমর্যাদায় ফিরিয়ে নিতে আমরা বদ্ধ পরিকর, আপনারা অসংশয়ে ফিরে আসুন, আমরা যথাযথ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছি (ভাবানুবাদ)। 
        কিন্তু কে নেবে হিন্দুর গর্ভে মুসলমানের বাচ্চা, মুসলমানের গর্ভে হিন্দুর বাচ্চা, শিখের বাচ্চা? কে নেবে? সেই মহিলারা তাই হারিয়ে যেতেই চেয়েছিলেন। হারিয়েই গিয়েছিলেন। সেদিন কতজন মুরাদ রুখে দাঁড়িয়েছিল, ফিরে এসেছিল জানা নেই। কিন্তু আমার বিশ্বাস একজন দুজন মুরাদ তো সেদিনও ছিল নিশ্চয়। 
        আজও রাস্তায় চলতে চলতে কোনো বয়স্কা, গলায় কণ্ঠী, বয়েসের ভারে ভারাক্রান্ত, দারিদ্যের অসম্মানেও মাথা তুলে বাঙাল ভাষায় কথা বলতে বলতে হেঁটে যাচ্ছেন দেখি, আমার মনে হয় থামিয়ে ভালো করে দেখি, মুরাদ নয় তো? 
        আমি শুধু জানি এসব ইতিহাস ভুলতে নেই। এসব মাথার কাছে রেখেই শুতে হয়, নইলে বেইমান হতে হয়, ওই ধর্ষকদের মত। মানুষই একমাত্র পারে স্মৃতিপথে প্রায়শ্চিত্তের দায় নিতে। তাদের সসম্মানে স্মরণ করে, ভুলে না গিয়ে। ভুলতে নেই যে।