ফ্লোরিডার ঘটনাটা গতকাল রাতেই শুনেছিলাম। আজ সকালে আনন্দবাজারের প্রথম পাতার খবরের শিরোনাম দেখে থমকে গেলাম – ‘সমকামী নাইট ক্লাবে বন্দুকবাজের হামলা’। থমকে গেলাম। অন্য কয়েকটা পেপারের হেডলাইনে চোখ বুলালাম। না তো! Times of India. The Telegraph, এই সময় ইত্যাদি খবরের কাগজে হত্যার কথা দিয়েই খবরের শিরোনাম, তাদের যৌনতার নিরিখে আলাদা করে নয়। আচ্ছা এটা যদি ভিন্নকামী যৌন সম্প্রদায়ের ক্লাবে ঘটত, তবে কি শিরোনাম হত? ‘ভিন্নকামী নাইট ক্লাবে বন্দুকবাজের হামলা?!’ না হত না। অন্তত আমার চোখে পড়েনি এমন কোনো হেডলাইন।
তবে কারণটা সেই – লঘুসম্প্রদায়ভুক্তকরন? সারা বিশ্বেই এই সম্প্রদায়ের উপর অধিকাংশ মানুষেরই রায় সদর্থক নয়। যুক্তি যাই থাকুক না কেন, কথাটা হল না পছন্দ করার। ভারতের পূর্ববর্তী প্রধানমন্ত্রীকে ভারতের সমকামী সম্প্রদায় মানুষের কথা জিজ্ঞাসা করা হলে, তিনি সাফ জানিয়ে দেন, এ ধরণের মানুষ ভারতে নেই, থাকলেও তা এতই নগণ্য সংখ্যায় যা উপেক্ষণীয়।
আন্তর্জাতিক মহলে হাসির রোল উঠেছিল। রাষ্ট্রসংঘ ভর্ৎসনা করেছিল। তারপর তো অনেকদূর জল গড়ালো। দিল্লী হাইকোর্টে সমাধানের রাস্তা তৈরি হতে না হতেই সুপ্রীমকোর্ট বাধ সাধল। এখন আবার তা বিচারাধীন। কি বিচারাধীন? না একজন নগ্ন পুরুষকে দেখলে একজন পুরুষের কামভাব আসা উচিৎ কি না? একজন পুরুষের আরেকজন পুরুষের সাথে সারাজীবন থাকার ইচ্ছাটা ন্যায়সংগত কি না? তারা যৌনক্রিয়ায় লিপ্ত হতে চাইলে সেটা কিভাবে হওয়া উচিৎ? মহিলার সাথে মহিলার ক্ষেত্রেও বিষয়টা একই অবশ্যই তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এ বিষয়গুলো কারা ঠিক করবেন? না যারা তথাকথিত সুস্থ, অর্থাৎ বিপরীত লিঙ্গেই যৌন আকর্ষণ অনুভবকারী নরনারীসমূহ। তারা কি করে বিচার করবেন? কেন না? ধর্ম, সামাজিক মঙ্গল-অমঙ্গল নিয়ে তাদের বিশদ অভিজ্ঞতাই পথ দেখাবে। তারপর তারা এও হয়তো ঠিক করে দেবেন কি করে এর থেকে সুস্থতা(!) লাভ করা যায়। অর্থাৎ, একজন মানুষের শোয়ার ঘরের দরজা এখন কোর্ট চত্বরের দিকে ‘হাঁ’ করে তাকিয়ে, কার তার ঘরে আসার অনুমতি আছে আর কার নেই তা জানতে।
আচ্ছা আমি যে এত প্রতিবাদ জানাচ্ছি, আমার নিজের কি খুব সহজ ছিল এই সম্প্রদায়ের মানুষকে আন্তরিকভাবে স্বীকার করা? না, মোটেই না। কলেজে পড়তে তখন এইডস নিয়ে ব্যাপক চর্চা দেশে-বিদেশে। আমারও প্রবল উৎসাহ, কিছু একটা করা উচিৎ। সাথে দায়বদ্ধতা, কারণ আমি নিজে জীববিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র। অগত্যা আমার যেন আরোও দায়। যুক্ত হলাম তখনকার কলকাতার একটা বিখ্যাত এইডস সংক্রান্ত সচেতনতা প্রচারকারী সংস্থার সাথে, অবৈতনিক স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে। মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে সরাসরি সোনাগাছি গিয়ে তাদের সচেতন করার মত সাহস দেখাতে পারলাম না। বোধহয় মফস্বলে বড় হয়ে সদ্য কলকাতায় পা দিয়েই, নিজের মানসিক ভীতিগুলোর সাথে পুরোপুরি লড়ে উঠতে পারিনি তখনো। যা হোক, আমার সহৃদয় দাদা-দিদিরা আমায় LGBT-দের কমিউনিটিতে গিয়ে সচেতনতার অভিযান চালাতে বললেন। অবশ্যই সাথে বড়রা যাবেন।
আমি ‘LGBT’ শব্দটা সেই প্রথম শুনলাম। পৌঁছে ভীষণ অস্বস্তিতে পড়লাম। কারণটা বুঝতে পারলাম না। শুধু মনে হতে লাগল ওরা খুব অন্যরকম। ওদের চলা-বলা, নিজেকে প্রকাশ করার ধারা ইত্যাদি সম্পূর্ণ আলাদা।
আজ স্বীকার করি, আমার বিরূপ মনোভাবই হয়েছিল। তীব্র বিরূপতা হয়েছিল। আমার ঔদ্ধত্য এতটাই ছিল যে আমি মিথ্যা অজুহাতে ফিরে আসি। বেশ কিছুকাল কেটে যায়। ঘটনাচক্রে একজন অত্যন্ত শিক্ষিত অধ্যাপকের সাথে পরিচয় হয়, যিনি সমকামী। তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্যে আমার কূপমন্ডূকতা দূর হয়, বিভিন্ন ঘটনার উদাহরণে আমি বুঝতে পারি, আমার বোঝার ভুল কি সাংঘাতিক ছিল। আমি সেদিন যা ঘটিয়েছিলাম তা অপরাধ শুধু না, পাপ।
ততদিনে আমি শিক্ষাক্ষেত্রের গণ্ডি পেরিয়ে কর্মক্ষেত্রে। আরো নানান মানুষের সাথে সাথে কিছু সমকামী বন্ধুও হল। তাদের বন্ধুত্বের উষ্ণতা, মানবিকতা আমার অনেক তথাকথিত স্বাভাবিক বন্ধুদের থেকে অনেকাংশে এগিয়েই দেখলাম বেশ কিছু ক্ষেত্রে।
এর সাথে আরেকটা মজার ঘটনা ঘটতে লাগল। স্কুলজীবন থেকেই আমার বন্ধু তালিকায় পুরুষদের সংখ্যা বরাবরই বেশি। তার সহজ কারণটা হল, আমি যে ধরণের আলোচনা বা তর্কে জড়িয়ে পড়তাম তা বেশিরভাগ মেয়েদের কাছেই খুব শুষ্ক, অকারণ মাথাচাটা, বা মাথা খারাপের লক্ষণের মধ্যে পড়ত। (মহিলা পাঠিকারা কিছু মনে যেন না করেন, এটা আমার দুর্ভাগ্যই বলতে পারেন, হয়তো সেরকম কারোর সাথে আমার পরিচয় হয়ে ওঠেনি।)
তো কথাপ্রসঙ্গে আমায় শুনতে হয়েছে, “তুই কি গে?” আগে বিরক্ত হতাম। নিজের মানসিকতার পরিবর্তন হওয়ার পর থেকে বলতাম, “না ভাই, হলে আমি নিজেই জানিয়ে দিতাম।” কারণ এখন আমার অনেক গে বন্ধু, গে ছাত্র। তাদের সম্মান করতে আমায় আলাদা করে ডিপ্লোম্যাট হতে হয় না।
আজও এ প্রশ্ন শুনি না যে তা না। এমনকি এও শুনেছি, রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ প্রমুখ ব্যক্তিরাও নাকি গে ছিলেন। কারণ একটাই – তারা বিয়ে করেন নি, আর করলেও স্ত্রীসঙ্গ করতে অক্ষম ছিলেন। বোঝো।
আজকাল ফেসবুকের দৌলতে এমন ঘটনাও ঘটেছে। কোনো সমাজ স্বীকৃত স্বাভাবিক পুরুষ আমার কোনো ‘সমকাম’ সমর্থনজনিত লেখার কথা জানতে পেরে অত্যন্ত গা ঘিনঘিনে ঔদার্য্যের সাথে মেসেঞ্জারে জানতে চেয়েছেন, “আপনি/তুমি কি গে?” এবং সেই মহৎ ব্যক্তিগণ এও আশ্বাস দিয়েছেন যে আমি সত্যটা জানালে তারা সে তথ্য গোপন রাখবেন। আশ্চর্য হয়েছি, এত শিক্ষিত হয়েও এ কেমনধারা রুচি? বলতে সঙ্কোচ হয়, এদের মধ্যে আমার অতি প্রাক্তন ছাত্রও আছেন।
আবার অন্যদিকে ফেসবুকে অদেখা পরিচয়ে অত্যন্ত আবেগমথিতা কোনো পাঠিকা উদ্বেল হয়ে মেসেঞ্জারে অতি নৈকট্যের ( অশালীনও বলা যায়) আবদারে প্রত্যাখ্যাতা হয়ে প্রশ্ন করেছেন, “আপনি/তুমি কি গে? তাহলে এত অসুবিধা কোথায়?” (যদিও এদের সংখ্যা অতি স্বল্প)
অর্থাৎ কিনা নীতিটিতি তো বাইরের বস্তু, ভাণের বস্তু। হয় তুমি গে, নয় তুমি অপারক। ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দ বলে কিছু হয় নাকি! অগত্যা ব্লক বা না অনুসরণের পথ নিতে হয় ফেসবুকে।
আমার পাঠক পাঠিকারা ক্ষমা করবেন। যৌনতা বিষয়ে এত সংকীর্ণ, অসহিষ্ণু মনোভাব চারদিকে, তার এমন কু-আত্মপ্রকাশ দেখে না বলে পারলাম না। এটা বোঝানো খুব কঠিন যে, কারোর যৌনতার পছন্দটা তার বিকল্প না, বাধ্যতা। শিশু বা পশুর বিকৃতকামের সাথে এই সমকামকে অবশ্যই অনেক অত্যুৎসাহী নীতিশীলেরা এক করে দেখে থাকেন। তারা করুণার বা উপেক্ষার যোগ্য, তর্কবিচারের না। এ দেশে ‘ফায়ার’, ‘মাই ব্রাদার নিখিল’, ‘আলিগড়’-এর মত সিনেমার অনুমতি পাওয়া যায়, অথচ বাস্তব জীবনে তাদের স্বীকার করে নিয়ে মাথা তুলে হাঁটার অধিকার দেওয়া যায় না। আশ্চর্য লাগে!
আর হত্যার বিষয়ে কি বলি। যে প্রতিষ্ঠানটার নাম (IS) এই হত্যার সাথে জড়িয়ে তারা প্রশংসার দাবী রাখে। তাদের নিষ্ঠা, সাহসিকতা, সাধারণ মানুষকে মারার নিপুণ কারিগরি দক্ষতাকে কুর্ণিশ না জানিয়ে যাই কোথা? তারা মানব সভ্যতাকে এক কালো চাদরে ঢেকে রাখতে চাইছে, চাইবেও। নোম চোমস্কী মহাশয়েরা যতই এর উত্থানের নানান ব্যাখা করুন, তবু এর সমাধানের পথ কারোরই জানা আছে বলে তো প্রত্যয় হয় না। বৈষম্যতা থাকবেই। তার বিকারও থাকবেই। এখন রোগের কারণ নিয়ে মাথা বেশি না ঘামিয়ে, কি ভাবে জীবাণুর সংখ্যা অথবা প্রতিক্রিয়া কমানো যায় সেই ব্যবস্থাই বেশি করে করা দরকার।