Skip to main content

সুকৃতিবাবুর কোনো অভ্যাস হতেও যতক্ষণ, যেতেও ততক্ষণ। এই যেমন, পুজোর ছুটির পর পর শিয়ালদায় নামলেন। বেশ ভিড়। অস্বস্তি হল। অথচ এই ভিড়ে গেল সপ্তাহ অবধিও তো কত অভ্যস্ত ছিলেন। প্রচণ্ড চাপ তলপেটে। টয়লেটে এসে লাইনে দাঁড়ালেন। চারজন পর সুযোগ এলো। এইবার? কিছুতেই হচ্ছে না। নার্ভাস লাগছে। এক হাতে দূরে দূরে দু’পাশে দু’জন। আহা কি স্রোত। পিছনে লাইনে লোকজন, অপেক্ষা করছে, উসখুস করছে। কিন্তু আসছে না। পেট অবধি জ্যাম। নামছে না। এভাবে হবে না। চোখ বন্ধ করলেন। ভাবলেন বাড়ির টয়লেটের কথা। বাইরে সিরিয়ালের আওয়াজ। এই তো নামছে! আহা! শান্তি! বিজয়ীর হাসি হেসে, লাইন ভেদ করে বাইরে এসে দাঁড়ালেন। রথ কই? মানে বাস?

অফিসে ঢুকে চোখমুখে জল দিয়ে বসলেন। মোবাইলটা অন্‌ করতেই হুড়মুড় করে ঢুকল বিজয়ার শুভেচ্ছা। বেশির ভাগই ফটো। তিনিও ক’টা ফটো ফরওয়ার্ড করলেন। কেন এখানে? কি করছেন? সামনে ফাইলের স্তূপ। কেন তিনি? কে? এই জন্যেই কি পৃথিবীতে আসা? এই ফাইলের মধ্যেই কি সবটুকু জীবন যাবে? না অবশ্য, কালীপুজোর পরেরদিনই তো ট্যুরপার্টির সঙ্গে কেরল যাচ্ছেন। তবু সে তো কদিনের ছেদ শুধু। এত ফাইল, এত ফাইল! মানুষের পিতৃঋণ, মাতৃঋণ যেমন হয়, তার যেন ফাইলঋণ।

আবার দশ কুড়িটা শুভ বিজয়ার ছবি পাঠালেন। এখনই কাজ করতে ইচ্ছা করছে না। বাইরে এলেন। শম্ভু হাসল। বলল, আদা দিই?

দে।

বেঞ্চে বসলেন সুকৃতিবাবু। আদা চায়ের সকাল। ভালো ভালো। কিন্তু শম্ভু কেন শুভ বিজয়া বলল না। না বলুক।

হাতে চায়ের কাপটা নিয়ে বললেন, শম্ভু শুভ বিজয়া।

শম্ভু বলল, আর কি শুভ দাদা.. মা চলিয়ে গেল সপ্তমীর দিন সকালে….

শম্ভু বিহারের মানুষ। কথায় বিহারি টান। ন্যাড়া হয়নি কেন? একি প্রশ্ন? সুকৃতিবাবু অবশ্য জিজ্ঞাসা করলেন অন্য প্রশ্ন.. কত বয়েস হয়েছিল?

শম্ভু বলল, আশির উপরে হবে….

অসুস্থ ছিলেন?

হাঁ…. বহুত দিন… কিডনি খারাব ছিল….

মৃত্যু। বাহ্! এর কাছে শুভ বিজয়া হয় কি করে?

কিছু দূরে একটা মাঠ আছে। সুকৃতিবাবু মাঠের দিকে এগোলেন। মাঠে আধখোলা প্যাণ্ডেল। মাঠের একধারে সিমেন্টের বাঁধানো বসার জায়গা। বসলেন। পকেট হাতড়ে ওয়ালেটটা বার করলেন। আঙুল দিয়ে ওয়ালেটের বুকটা খুললেন। ভিতরে আঙুলটা এগিয়ে দিলেন। ঠাণ্ডা স্পর্শ পেলেন। নূপুরের। হাতে নিলেন। চুমু খেলেন। হাতে নিয়ে বসে থাকলেন। সব অভ্যাস চলে যায়। আসে আর চলে যায়। কিছু যায় না। মেয়েটা মাত্র চারটে দুর্গাপুজো দেখেছিল। সব জামা, জুতোগুলো রাখা আছে। কিছু জামা তো খোলাই হল না। একদম নতুন। সেদিনও ছিল দশমী। সব ফিরে যাওয়া কি শুভ হয়? যদিও সে মা দুর্গার সঙ্গেই ফিরে গেছে দশমীর দিনে। তবু… ফাইল… একমাত্র ফাইলই পারে সব ভুলিয়ে দিতে।

সুকৃতিবাবু অফিসে ঢুকতে যাবেন, দেখেন শম্ভু চুপ করে বসে আছে বেঞ্চে। উদাস।

সুকৃতিবাবু পাশে গিয়ে বসলেন। শম্ভু হাসল। সুকৃতিবাবু আবার নূপুরটা বার করে শম্ভুর হাতে দিলেন… বললেন, নেই রে… চলে গেছে…. বারো বছর হল…. যে যায় সে যায় শম্ভু… আটকানো যায় না…. আমরা যারা থাকি তারা থেমে যাই… ঠেলে ঠেলে চলি…. তুই চা করে খাইয়ে যা… আমি ফাইল ঠেলে ঠেলে চালিয়ে যাই… এতেই ভালো থাকতে হবে….

শম্ভুর চোখের কোলে বড় বড় দু ফোঁটা জল জমেছে। এখনই গড়াবে, দাড়ি না কাটা গাল গড়িয়ে।

সুকৃতিবাবু উঠতে যাবেন, শম্ভু জিজ্ঞাসা করল… নাম কি ছিল?

সুকৃতিবাবু বললেন, রমা।

নামটা ঠোঁটে বাড়ি খেয়ে বুকের আগলে ধাক্কা দিল। কতদিন পর!

অফিসের চেয়ারে বসে মোবাইল অন্‌ করলেন। আবার শুভ বিজয়ার ঢল। আবার উত্তর করলেন। ফাইলে ডুবতে হবে। কত অল্প ফাইল জমে। কিন্তু রাস্তা তো অনেকটা!

মেসেজ ঢুকল। সুজাতার। "সময় করে খেয়ে নিও"।

সুকৃতিবাবু লিখলেন, "তুমিও"।