Skip to main content

আমরা পারিবারিক জীব, না সামাজিক জীব?


    আরো ভালো করে বলি, আমরা কি শুধুই পারিবারিক জীব নাকি সামাজিক জীবও?

    কদিন আগে বেশ কিছু খবরে দেখা গেল জনসংখ্যা প্রবল আকার ধারণ করছে বিশ্বজুড়ে। অবশ্যই এটা একটা খুব আলোচিত বিষয় বিশ্বজুড়ে। এমনকি গ্রামে গ্রামেও এই সচেতনতা নিশ্চয়ই পৌঁছিয়েছে, ছোটো পরিবার সুখী পরিবার। নইলে ওই তেইশজন মহিলা, খাগারিয়ায় টিউবেক্টমি করাতে যাবেন কেন? তার মানে ধরে নেওয়া যায় তাদের বাড়ির লোকও সম্মতি জানিয়েছিলেন যে এটা দরকার। মানে অতি জনসংখ্যা বেশ একটা ভয়ের জিনিস সেটা বেশ গ্রাসরুট লেভেলেও বোঝানো গেছে।

    তারপর কি হল? হাস্পাতালে গেলেন তারা। ধরা যাক আমি দাঁত তোলাতে গেছি সরকারি কোনো ডেন্টিস্টের কাছে। আমার টাকাপয়সা নেই। মানে অলরেডি আমি অনেকটাই সমস্যার দিকে, আমার অপশান কম অন্য কোথাও যাওয়ার। লাইনে বসলাম। আমার নাম ডাকা হল। আমি দাঁত তোলার চেয়ারে গিয়ে বসলাম। ডাক্তারবাবু আমার মুখটা হাঁ করে, মুখের মধ্যে সাঁড়াশির মত কিছু একটা ঢুকিয়ে দিয়ে দাঁতটা উপড়াতে শুরু করলেন।

    কোন পয়েন্টটা মিস করলাম বলুন তো? হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন, আমায় কোনো অ্যানেস্থেশিয়া দেওয়া হয়নি। মানে অসাড় করার ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়নি। তখন উপায়? আছে। চার পাঁচজন মানুষ আমার দুটো হাত, আর দুটো পা চেপে ধরে থাকবেন। আর একজন মাথা। অবশ্যই তারা হৃষ্টপুষ্ট হবেন। এরকম ছবি দেখেছেন?

    আমি দেখেছি। ইতিহাস বইতে। সুশ্রুত অপারেশান করছেন। কয়েকজন রুগীর হাত-পা চেপে ধরে আছে। ছবির নীচে ব্র‍্যাকেটে লেখা আছে, তখন যেহেতু অ্যানেস্থেশিয়া আবিষ্কার হয়নি তাই ওভাবেই শল্যচিকিৎসা হত।

    আমার মাথা, চোয়াল যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছে, আমার মুখের ভিতর থেকে গোঁ গোঁ আওয়াজ বেরোচ্ছে। আমি আমার নরকবাস অনুভব করছি।

    দেখুন, কেমন দুটো মিথ্যাকথা গুছিয়ে লিখলাম। প্রথম কথা বিনা লোকাল অ্যানেস্থেশিয়া দাঁত তোলার অভিজ্ঞতা আমার নেই। ওটা মিথ্যা। অনুমান মাত্র। আর দুই, নরকের অভিজ্ঞতাও আমার নেই। ওটাও অনুমান মাত্র। কিন্তু বিহারের খাগারিয়ায় এগুলো বাস্তব।

    অযথা রাজনীতির দৃষ্টিতে ভাববেন না। এটা মানবিকবোধের ত্রুটি। পাপ। আমি চিকিৎসক নই। তবু বেশ কিছু চিকিৎসকের কথায় জানলাম যে টিউবেক্টমি করতে অবশ করা লাগে। নইলে ভীষণ যন্ত্রণা হয়। একজন মানুষকে যন্ত্রণার হাত থেকে রেহাই দিয়ে চিকিৎসা করতে নিশ্চয়ই কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শ লাগে না। লাগে কমোন সেন্স আর সিম্পল দায়িত্ববোধ। অথচ এই দুটোর কোনোটা ছাড়াই তেইশজন মহিলা এই দুঃসহ অনুভবের মধ্যে দিয়ে গেলেন। দোষ তাদের ছিল। তারা পারিবারিক জীব। তারা গরীব। হয় তো বা অশিক্ষিতও এতটা যে জানেনই না এটা তারা ডিজার্ভ করেন না। তারা অপারেশান থিয়েটারের ভিতরে নাকি প্রাণপণ চীৎকার করেছেন ব্যথায়। বাইরে থেকে সে শব্দ নিশ্চয়ই শোনাও গেছে। বাইরে হয় তো বা তার ছোটো বাচ্চাটা ছিল, বা তার স্বামী বা আর অন্য কোনো আত্মীয়। নিশ্চয়ই কুঁকড়ে গিয়েছিলেন সে প্রাণান্তকর চীৎকার শুনে। কিন্তু সেই চীৎকার করা মহিলা আর তার আত্মীয়স্বজন নিশ্চয়ই কৃতজ্ঞও ছিলেন বিনা পয়সায় এই সুযোগটা পাচ্ছেন বলে। তাই তারা যে একটা অপরাধের শিকার তাও অনুভব করলেন না যতক্ষণ না আরেকজন উচ্চপদের মেডিকাল অফিসারের নজরে এলো পুরো ব্যাপারটা।

    এই গোটা ব্যাপারটা ঘটে গেল একটা দেশে, যেখানে গ্রামে গ্রামেও ফোরজী নেট কানেকশন ঢুকে গেছে, ফাইভজী চলে এলো প্রায়, অন্তত প্রতিশ্রুতি তাই শোনা যাচ্ছে। মেডিক্যাল নেগলিজেন্স বাস্তব ঘটনা একটা। একটা ভুল হয়ে যায় অনিচ্ছায়, এটা বাস্তব। সবাই মানুষ, ভুল হয়। কিন্তু এ তো ভুল নয়, এতো আগেকার দিনের রাক্ষস-খোক্কসের গল্পের মত। ইচ্ছা করে যন্ত্রণা দেওয়া। কি আশ্চর্য!

    আমরা পারিবারিক জীব, না সামাজিক জীব? এ একটা বড় দ্বন্দ্ব। এর মধ্যে একটা সাম্য ঠিকঠাক তৈরি না হলে বারবার ঠকে যেতে হবে। পরিবার না হলে সমাজ যেমন টিকবে না, তেমনই সমাজ না থাকলে পরিবারের টেকাও মুশকিল। ভুল বললাম, সুস্থ সমাজ না হলে সুস্থ পরিবারের টিকে থাকা খুব মুশকিল। ছোটো পরিবার অবশ্যই সুখী পরিবার। কিন্তু সুস্থ সমাজ মানে সুরক্ষিত পরিবার - এও সত্য।

    খাগারিয়ার এ ঘটনাটা চূড়ান্ত অমানবিক, লজ্জার। ছিঃ!