সৌরভ ভট্টাচার্য
11 February 2019
তখনও বর্ষা আসেনি। প্রচণ্ড গরম। দুপুরবেলা, শিয়ালদায় যাচ্ছি। ট্রেনের মধ্যেটা অগ্নিকুণ্ড হয়ে। প্রচণ্ড ভিড়। গ্যালোপিং ডাউন শান্তিপুর লোকাল।
সামনের সারিতে মেঝেতে একজন মহিলা শুয়ে। একহাতে স্যালাইন লাগানো, আরেকজন মহিলা ধরে বসে, তিনিও মেঝেতেই বসে। সিটে বসা লুঙ্গী আর নীল চেক চেক জামা গায়ে একজন লোক। কাঁচাপাকা দাড়ি। হাতে নানা ডায়েগোনেস্টিক সেন্টারের প্লাস্টিক। জানলার কাছে দাঁড়িয়ে দুটো বাচ্চা, একটা ছেলে আর মেয়ে।
কথাবার্তায় বুঝলাম মহিলার কিডনির অসুখ। সপরিবার রাণাঘাট হাস্পাতাল থেকে নীলরতনে যাচ্ছে।
হকারের পর হকার উঠছে হাঁকছে নামছে। বাচ্চাদুটো জানলা থেকে মুখ ফিরিয়ে অপলক চোখে খানিক তাকাচ্ছে এর ওর দিকে, তারপর বাবার উদ্বিগ্ন অন্যমনস্ক মুখে, মায়ের বন্ধ চোখ কাহিল মুখের দিকে তাকিয়ে আবার জানলায় মুখ রাখছে। জগদ্দল, শ্যামনগর, ইছাপুর, পলতা... চড়া রোদ, বাতাসের হল্কা, একঘেয়ে দৃশ্যাবলী, দুটো শুকনো বাচ্চামুখ।
হঠাৎ বাচ্চা মেয়েটা বসা লোকেদের হাঁটু ছুঁয়ে ছুঁয়ে, একটু সরিয়ে সরিয়ে, কারোর ঘুম ভাঙিয়ে, কারোর বিরক্তি ঘটিয়ে বাবার দিকে এগোতে লাগল। বাবার কাছে পৌঁছে কিছু বলার জন্য ঘাড়টা যদ্দূর সম্ভব উঁচু করে, পায়ের আঙুলগুলোতে ভর করে দাঁড়াল, খেয়াল করিনি এতক্ষণ, ছোট্টো পাদুটো খালি। বাবা মাথা নীচু করে তার ছোট্টো শরীরটা হাতের বেড়ে জড়িয়ে, মাথাটা নীচু করে কানটা তার ঠোঁটের কাছে আনল। লোকটার গলায় একটা কালো সুতো সার্টের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে ট্রেনের দুলুনির সাথে দুলতে লাগল।
কথা হল। বাবা উঠে, একজন, দুজন মানুষের ঘুম চটিয়ে, বিরক্তির আওয়াজ শুনতে শুনতে বাঙ্কের থেকে একটা প্লাস্টিকের বড় প্যাকেট পাড়ল। সেটা নিয়ে আরেক দফা বিরক্তির অব্যয়সূচক শব্দ শুনতে শুনতে নিজের জায়গায় এসে বসল। মেয়েটা এতক্ষণ নিজেকে বাবার সিট ধরে স্থির দাঁড়াবার খেলায় ব্যস্ত ছিল। বাবা বসতেই উৎসুক হয়ে প্লাস্টিকের খোলা মুখের মধ্যে মুখ ঢুকিয়ে দিল, সাথে বালা পরা ছোট্টো ডান হাতটাও। মুড়ি ভর্তি একটা সাদা প্লাস্টিকের থলে বার করল। না, অল্প চানাচুরও আছে। এতক্ষণ যার গলা শোনেনি কেউ, সে গলার তীক্ষ্ণ স্বরে সবাইকে চমকে দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, "এই দাদা মুড়ি খাবি এখন?"
দাদা এতক্ষণের ঘটনাগুলো যে একেবারেই দেখেনি তা নয়, মাঝে মাঝেই মাথা ঘুরিয়ে আড়চোখে দেখে নিয়েছে, হয়ত বা নিঃশব্দে সময় মত এসে নিজের ভাগটুকু নিয়েও যেত, কিন্তু বোনের এমন আকস্মিক চীৎকারে লজ্জা পেয়ে, চারদিকে এক ঝলক তাকিয়ে, জানলার দিকে মুখ ফিরিয়ে নিল। হ্যাঁ বা না কিছুই বলল না। ততক্ষণে অবশ্য বোন ফিরে ডাকার মত অবস্থাতেও নয়। তার মুখ ভর্তি চানাচুর মুড়ি, বাবার কোলে বসে মাথাটা বাবার পাঁজর বেরোনো বুকে এলিয়ে, পা দুটো লুঙ্গীর খাঁজের মধ্যে ঢুকিয়ে চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চারদিক দেখতে দেখতে চিবোচ্ছে। হকারের কাঁধে ঝুলানো বাদামের মালাও দেখছে, কৌতুক আছে, বায়না নেই আর।
মা চোখ খুলে তাকাল। একটা কিছু নাম ধরে ছেলেটাকে ডাকল, শুনতে পেলাম না। ছেলেটা মাথা ঘুরিয়ে মায়ের দিকে তাকাতে মা বলল, বোনের সাথে একটু মুড়ি খেয়ে নে না বাবা, সক্কাল থেকে তো কিছুই....
একটা 'ওক' উঠে এলো মনে হল মহিলার। স্যালাইন হাতে আরেকজন মহিলা তাড়াতাড়ি বাঁ হাত দিয়ে পিঠ টেনে দিতে দিতে বলল, কথা বোলো না দিদি.. বমি হয়ে যাবে... থাক ও খাবেখন.. তুমি চোখটা বন্ধ রাখো... কেউই তো খাইনি আমরা, শিয়ালদায় নেমে খেয়ে নেবখন কিছু।
মহিলা ফ্যালফেলে চোখে একবার স্বামীর মুখের দিকে তাকাল, তারপর ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করল আবার।
ট্রেন বেলঘরিয়া ছেড়ে গেছে। ভিড় প্রচণ্ড। এরকম হলে অ্যাম্বুলেন্স দিতে হয় হাস্পাতাল থেকে, নয়ত ভাড়া গাড়ি নিতে হয়, ভেণ্ডারে যেতে হয়, আগের সরকার বনাম এখনকার সরকার, আগের গরম বনাম এখনকার গরম..আলোচনার পর আলোচনা হারিয়ে যেতে লাগল।
শিয়ালদায় ঢুকল। তাড়াহুড়ো। মহিলা উঠতে গিয়েই বমি করে দিল। ততক্ষণে সবাই জেনে গেছে এইটা আপ বনগাঁ লোকাল। অফিস ফেরত যাত্রীরা নাকে কাপড় দিয়ে অস্পষ্ট, স্পষ্ট গালাগালি দিতে দিতে সরে গেল, ফাঁকা জায়গায় ঝাঁপিয়ে পড়ার লড়াই এখন।
ছেলেটা মায়ের পাশে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে। মেয়েটা বাবার কোলে ঘুমিয়ে। স্যালাইন হাতে মহিলা একহাতে অসুস্থ মহিলার হাতের মধ্যে হাত দিয়ে আরেক হাতে স্যালাইন ধরে এক পা এক পা প্ল্যাটফর্মের ভিড়, ঠেলাঠেলি সামলে এগোবার চেষ্টা করছে। ক্রমে ভিড়ে আড়াল হয়ে যাচ্ছে। মাইকে ঘোষণার পর ঘোষণা হচ্ছে নানা ট্রেনের। গরমটা গুমোট। লোকে বলছে কালবৈশাখী হবে আজ। কোথায় যেন খুব ঝড় হয়েছে। এদিকেও হবে। খুব বৃষ্টি হবে। গরমটা কমবে। সবাই অপেক্ষা করছে, দৌড়াচ্ছে। ফাঁকা সিট, জানলার ধার, একটা কালো জল ভর্তি মেঘ আর সময়ে বাড়ির দরজায় থামা ট্রেন, এইটুকুই তো চাই।