আটদিন হল, একটা টিভিও খারাপ হয়নি!
সুনীল শর্মা চায়ের কাপ নিয়ে অন্ধকারে মাঠের দিকে তাকিয়ে। এই শহরে সে অনেক বয়স্ক টিভি মেকানিক। কত টিভি এলো গেল, পরিবারগুলোর মত। সম্পর্কগুলোর মত।
কিন্তু বাজারে কম্পিটিশান বাড়ছে। আর আধুনিক মডেলের টিভিগুলো ভালো বোঝে না সুনীল। বয়েসও তো হয়েছে। প্রায় ষাটের কাছাকাছি।
চায়ের ভাঁড়টা শেষ। পকেট ফাঁকা। দুটো বিয়েবাড়ি আছে। গিফট্ কিনতে হবে।
সুনীল অভাব ভোলার জন্য রাগের অভিনয় করে। যার যার উপর রাগ তাদের বাজে ব্যবহার, কটুকথা মনে করে। জীবনের উপর একটা নির্মোহ জন্মায়। ভালো লাগে। এমনকি নয়নাকে সন্দেহ করতেও ইচ্ছা করে। ছেলেটাকে মূর্খ ভাবতে ইচ্ছা করে। ভাবেও। যত ভাবে তত রাগ হয়, জীবনে বিতৃষ্ণা আসে। অভাবটা সহ্য হয়ে যায়।
আজ কিছুতেই রাগ হচ্ছে না। আজকাল লোকে খারাপ ব্যবহার করে না। উপেক্ষা করে। রাস্তায় দেখলে চিনতেই পারে না। তাতেও রাগ হচ্ছে না। মনে খালি টাকাটার কথাই আসছে।
বাড়ি ফিরল। নয়না বোঝে। কাজ হয়নি আজও। নয়নার দিকে তাকায় না। ছেলেটা পড়ছে। চাকরির জন্য পড়ছে। কোনোদিন পাবে না। হাতের কাজও শিখবে না।
নয়নাকে বলল, এবার না ভিক্ষা করতে বেরোতে হয়।
সঞ্জয় পড়া থামিয়ে বলল, ট্রেনে, না প্লাটফর্মে?
সুনীল মাথাটা ঠান্ডা রাখল। অন্তত চেষ্টা করল। নয়না বলল, পড় বাবু!
সঞ্জয় বলল, আমি কিন্তু যাব না। আমার লজ্জা লাগবে।
সুনীল গালাগাল করল। নয়না বলল, জানোই তো ওর বুদ্ধির কথা.... ছাড়ো..... কাজ ঠিক আসবে....
সুনীল বলল, আমরা না খেয়ে মরব তদ্দিনে.....
সঞ্জয় আবার কিছু বলতে যাচ্ছিল। নয়না ধমক দিয়ে থামালো।
রাত বেড়েছে। সুনীলের ঘুম আসছে না। নয়নাও জেগে। সুনীল বলল, সত্যিই যদি ভিক্ষা করতে হয়?
নয়না বলল, আমিও যাব। গান জানি ক'টা.... গাইব? শুনবে?
সুনীল হেসে ফেলল। নয়নাও হাসল। সঞ্জয় ঘুমাচ্ছে। সুনীল বলল, ছেলেটার কি হবে গো আমরা চলে গেলে?
========
আরো দশদিন কোনো কাজ এলো না। সুনীল আজকাল কথা বলাই বন্ধ করে দিয়েছে পারলে। সংসারে সত্যিই টানাটানি আসবে নয়না বুঝতে পেরেছে। সুনীলের থেকে সে আঠারো বছরের ছোটো। খেটে খাবে। সেলাই বাড়িয়ে দেবে। সেলাই ভালোই জানে। শুধু চোখটাই যা সাথ দেয় না।
সমস্যা শুরু হল হঠাৎ দু'দিন ধরে সঞ্জয় বেপাত্তা হয়ে গেল যখন। সুনীল আর নয়না যেখানে সম্ভব খোঁজ নিল। কোত্থাও পাওয়া গেল না। চারদিন পর থানায় জানালো। আগেও দু'বার হয়েছে এরকম। মামাবাড়ি চলে গিয়েছিল উত্তর প্রদেশে। কিন্তু এবারে কোনো আত্মীয়ের বাড়িই তো যায়নি। তবে?
মাস গেল। সুনীল আর নয়না একরকমের নাওয়া খাওয়া ভুলেছে। রোজ থানায় যায়। সুনীল এর মধ্যে নয়নাকে নিয়ে উত্তর প্রদেশে ঘুরেও এসেছে। কোত্থাও নেই ছেলেটা।
ঘটনা যখন বছর ঘুরে গেল, তখন সুনীল আর নয়না ধরে নিল কোনো দুর্ঘটনায় পড়েছে। নইলে ওরকম বোকাহাবা ছেলেকে কে খাওয়াবে?
এদিকে সুনীলের কাজ বেড়েছে। আজকাল টিভি-র পাশাপাশি মোবাইল রিপিয়ারিং-এর কাজও বাড়িতে বসে করে। মোবাইলের জন্য কাজ আসে বেশি। আগেও মোবাইল সারানো শেখার কথা ভেবেছে, কিন্তু সাহসে কুলায়নি। সঞ্জয় চলে যাওয়ার পর যেন সবেতে সাহস বেড়ে গেল সুনীলের। আজকাল ঘরে আসতেও ভালো লাগে। ঘরে থাকতেও ভালো লাগে। এটা পাপ জানে সুনীল। কিন্তু এটাই তো সে। এটাই তো আসল। নয়না শুকিয়ে যাচ্ছে। যাক। মরুক। এক-একসময় নয়নার শবযাত্রা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে সুনীল, নয়নার গায়ে হাত রেখেই। একটা শীতল অনুভবে মাথা-বুক ভরে যায়। মোবাইলের কাজ করতে ভালো লাগে। বসে বসে সারাদিন মোবাইল ঘাঁটতে ভালো লাগে। রাস্তাঘাটে সঞ্জয়ের মত কাউকে দেখতে পেলে চমকে ওঠে। একটা মন উৎসুক হয়, আরেকটা মন আতঙ্কিত। তারপর যখন সেটা অন্য কেউ হয় মনে শান্তি নামে। অদ্ভুত শান্তি। অনেকক্ষণ মাইক চলার পর বন্ধ হলে যেমন শান্তি, তেমন শান্তি।
========
এইভাবেই চলছিল। ছটপুজো হয়ে গেছে। সুনীল এক মামাতো ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে যাদবপুর গেছে। দু'দিন পর ফিরে এসে দেখে বাড়ির দরজার কাছে একজন মোটা মত মানুষ বসে। বুকটা ধক্ করে উঠল সুনীলের। সঞ্জয় না?
সঞ্জয় বসে বসেই হাসছে তার দিকে তাকিয়ে। নয়না তার সাইকেলের আওয়াজ শুনে বাইরে বেরিয়ে এলো। কি সব হাউমাউ করে বলে যাচ্ছে। এতক্ষণ খেয়াল করেনি অনেকেই বাড়ির ভিতরে বাইরে বসে দাঁড়িয়ে। সঞ্জয় বিয়ে করে এসেছে। কানে এলো। একটা বাচ্চা মেয়ে এসে প্রণাম করল। সঞ্জয় লুধিয়ানায় একটা হোটেলে কাজ করে।
অনেক রাত। সবাই ঘুমাচ্ছে। নয়নার মুখে একটা প্রশান্তি। এতদিন ছিল না। সঞ্জয়-রাখী পাশের ঘরে শুয়ে। সঞ্জয়ের নাক ডাকার আওয়াজ পাচ্ছে। ওকি থাকবে? না চলে যাবে? সুনীল কি চায়? নয়না কি চায়?
সুনীল মাঠে এসে দাঁড়ালো। একা। ভীষণ একা লাগছে নিজেকে। ভীষণ একা। সঞ্জয় চলে গেলে কি আরো একা হয়ে যাবে? নাকি থেকে গেলে?