ফেসবুকের টাইমলাইনটা এতদিন আমার নিজস্ব ছিল। বন্ধুদের পোস্ট দেখতাম। ছবি, লেখা ইত্যাদি। এখন বন্ধুদের লেখাই প্রায় দেখতে পাই না। যাদের লেখা দেখি তাদের আমি চিনি না। তাদের নামের পাশে follow শব্দটা নীল অক্ষরে লেখা থাকে। কেন যে তাদের আমাকে ফলো করতে হবে তাও বুঝি না। আগে আসত আমার পরিচিতের পরিচিতর সাজেশান। ফ্রেণ্ড সাজেশানে। এখন আসে একেবারে কোনোরকম সম্পর্কসূত্রহীন মানুষের প্রোফাইল।
পরকে আপন করার শিক্ষা খুব বড় শিক্ষা। কিন্তু এক্কেবারে ঘরের মধ্যে পরকে ঢুকিয়ে গায়ে পড়ে আপন করিয়ে নেওয়ার শিক্ষাটা কেমন ধারার কথা বাপু! একে তো সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশিক্ষণ কাটালে ব্রেন রট হচ্ছে বলে সেই নিয়ে গোটা বিশ্বে কত আলোচনা। ব্রেন রট শব্দটা তো এদিকে যাকে বলে বাৎসরিক শব্দের মান পেয়ে গেল, word of the year! তায় আবার ফেসবুক খুললেই যদি অচেনা লোকের অনধিকার প্রবেশ আর তাদের নানাবিধ ধানাই পানাই সহ্য করতে হয়, তবে তো বড় চাপের ব্যাপার। পচন হবে সেপটিক হবে। সব মিলিয়ে ব্রেন বেসামাল হবে যে!
দেখুন এমনিতে প্রতি বছর একটাই শব্দ এখন word of the year সে হল ভায়োলেন্স। মানুষ যত কাছাকাছি আসে তত মারমুখী হয়। এই তো দেখছি। সোশ্যাল মিডিয়া দেখাচ্ছে মানুষ কতভাবে মারমুখী হতে পারে। অনন্ত বিদ্বেষ অনন্ত কাল ধরে সে লালন করে চলেছে। তার নানা বিস্ফোরণ এদিকে সেদিকে। বাক্যে, অস্ত্রে রে রে করে জগত জুড়ে মানুষ জাতি নেমে পড়েছে। সবাই চাইছে সে শুধু থাকবে বাকিরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। সে মানে সে নিজে বা নিজের মতের লোকেরা। পশুদের লড়াই শরীরের মাপের অস্তিত্ব রক্ষার। খাদ্য, স্থান ইত্যাদি। মানুষের লড়াই মত নিয়ে। মতের একাধিপত্য রক্ষার লড়াই। তোমার সঙ্গে আমার মত মিললে ভৌগোলিক দূরত্ব কিছু নয়, আবার মতে না মিললে তুমি গায়ে লেগে থাকলেও জাতশত্রু। কী আশ্চর্য!? মত সত্য না। বাস্তব না। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি আমার মতটাই হল ধ্রুব সত্য। আমার পূর্বপুরুষের দ্বারা লালিত বইটাই ধ্রুব সত্যের বই। পবিত্র! আমার মত পবিত্র। আমার মত সম্বন্ধীয় যাবতীয় যা কিছু পবিত্র। তোমার সবটাই হাস্যকর। কল্পনা। অপবিত্র।
মানুষ মত না। এক মানুষ একটা মত গড়ে। সেই মত অন্যের মাথায় চারিয়ে দেয়। মতের দল হয়। লড়াই হয়। বিদ্বেষ তৈরি হয়। মানুষ বিশ্বাস করে মতে মানুষ তৈরি হয়। কোনো জায়গায় বোমা ফাটালে, কোনো স্থাপত্য গুঁড়িয়ে দিলে, ধ্বংস করলে তাদের মতের নির্মাতা খুশী হয়ে তাকে বকশিস দেয়। এক এক মতের এক এক নির্মাতা। এক এক মতে জগত খোপে খোপে বিভক্ত হয়ে বসে আছে। এক এক মতের নির্মাতার স্তবস্তুতি আরেক মতের প্রতি বিদ্বেষের বিষবাক্যর সঙ্গে মিলেমিশে কী ভয়াবহতা সার্কাস চলছে। কেউ জানতে চাইছে না, সত্য কী! জানতে চাইছে তোমার মত কী!
পূর্বপুরুষের কুসংস্কার কি আমার কুসংস্কার? পূর্বপুরুষের অন্ধবিশ্বাস কি আমার অন্ধবিশ্বাস? আমার পূর্বপুরুষ সমাজের যে বিন্দুতে, যে সময়ে দাঁড়িয়ে ছিল, আমিও কি সেই একই জায়গায় দাঁড়িয়ে? পূর্বপুরুষের জীবনে যা যা ভয়, অনিশ্চয়তা, সমস্যা ছিল সে সব কি আমারও জীবনে বাস্তব? পূর্বপুরুষের যা যা সীমাবদ্ধতা ছিল সে সব কি আমারও আজকের সীমাবদ্ধতা?
সোশ্যাল মিডিয়ার দায়িত্ব ছিল সূত্র তৈরি করার, বাঁধার। বাস্তবে তা হল না। এর অবশেষে অবদান হল ব্রেন রটের কারণ হওয়া। মানুষ তবে মানুষের কাছে এলে এইভাবে মস্তিষ্কে পচন ধরায়? এত বিষাক্ত মানুষ? এত শিক্ষা, এত শিক্ষা, এত শিক্ষার এই ফল হল তবে? মহামানব আসবে না। সাধারণ মানুষ স্বার্থের সঙ্কীর্ণতা থেকে, মতামতের কম্ফোর্ট জোন থেকে বেরিয়ে সত্যগামী হবে না। তবে? মঙ্গলের উপায় কী? মত যে মঙ্গলের উৎস নয় দেখা গেল। ভালোবাসা, সহানুভূতি, অনুকম্পা, দরদ- এরাই নানা নামে মনুষ্যজাতিকে রক্ষা করে এসেছে। ভালোবাসা তো কোনো মত নয়। শুভবুদ্ধির মাতা। কিন্তু সে দরদিয়া কি বেঁচে আছে আজও?