Skip to main content
 
 
 
 
বঙ্কুবাবু ঠিক করলেন তিনি আর দু’দিন দেখবেন বড়জোর, তারপর নিজেই যাহোক একটা ব্যবস্থা করবেন। যেমন ভাবনা তেমনই কাজ। শুক্রবার অফিস ফেরার পথে তিনবার আইসস্ক্রিম খেলেন। অফিসে পাঁচবার ছাদে উঠে এই ভাদ্রের পচারোদ লাগালেন দশ মিনিট করে। বাড়ি ফিরে চুপিচুপি ফ্রীজ থেকে বরফ বার করে নিয়ে গিয়ে স্নান করলেন আচ্ছা করে। তারপর শুয়ে পড়লেন ফুলস্পীডে পাখা চালিয়ে দিয়ে। 
 
যা ভেবেছিলেন তাই হল, মাঝরাত থেকেই উদোম জ্বর। মনটা খুশীতে নেচে উঠল। ঘড়িতে দেখলেন সাড়ে তিনটে। ঠেলা মেরে মন্টাকেশ্বরীকে, মানে ওনার স্ত্রীকে বললেন, “ওই, একবার থার্মোমিটারটা আনো দিকিনি। আবেগে ওনার গলা জড়িয়ে আসছে।”
মন্টিদেবী তাড়াতাড়ি ধড়মড় করে উঠে এটা ওটা হাতড়িয়ে থার্মোমিটারটা আনলেন। ১০৩ ডিগ্রী, উফ্! কি আনন্দ বঙ্কুবাবুর। উত্তেজিত হয়ে বললেন, “আহা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি ভাবছ, যাও, ওষুধের ডিব্বাটা নিয়ে এসো গে!” মন্টিদেবী আনলেন। 
বঙ্কুবাবুর হাতে ৬৫০ প্যারাসিটামল। বঙ্কুবাবু পাতাটার দিকে আবেগঘন দৃষ্টিতে তাকিয়ে। দুটো ফোঁটা জলও পড়ল গাল বেয়ে। মনে মনে বললেন, ‘ইস আরেকটু হলেই হয়েছিল।’
মন্টিদেবী পাশ থেকে বললেন, “কি হয়েছিল গো?”
বঙ্কুবাবু সামলে নিয়ে বললেন, “না ওই আর কি!” 
বঙ্কুবাবু আবার প্যারাসিটামলের পাতাটার পিছনের দিকটা দেখলেন, ‘expiry date: sep, ’16’, অর্থাৎ কিনা আর দু’দিন পরে এই বুদ্ধিটা করলে পুরো চোখের সামনে এই এতগুলো ওষুধ নষ্ট হত। ভাবা যায়!
 
এটা বঙ্কুবাবুর চরিত্রের নতুন কোনো দিক না। শোনা যায় ওনার ঠাকুর্দা জোলাপের ডেট পেরিয়ে যাচ্ছিল বলে প্রথমে একমাস কাঁচকলা সিদ্ধ দিয়ে ভাত খেয়ে তারপর জোলাপ খেয়েছিলেন। তা খুব একটা সহ্য করে উঠতে পারেন নি বলে ৬৫ বছর বয়সে সরকারী হাসপাতালে দেহ রাখেন। নিন্দুকেরা বলে, ‘তিনি নাকি দেড়দিন হাসপাতালে ছিলেন। আর ওনার চলে যাওয়ার পরের দিনই হাসপাতালের সেফটি ট্যাঙ্ক পরিষ্কার করার জন্য খবর পাঠাতে হয়।’ 
 
আর বঙ্কুবাবুর বাবার ব্যাপারটা অবশ্য একটু অন্যরকম। উনি কিছু ভুল ওষুধের বিষক্রিয়ায় মারা যান। সেগুলোর নাকি এক্সপায়ারী ডেট প্রায় হয়ে এসেছিল। নিন্দুকেরা বলে সেগুলো নাকি গর্ভনিরোধক বড়ি ছিল। ওনার স্ত্রী’র ইউটেরাস অপারেশানের পর উনি নাকি খেয়ে ফেলেন, লোকেরা বলে, আমি নই।
সে যাক, আপাতত বঙ্কুবাবুর তুমুল জ্বর। মাঝে মাঝে ঘোর লাগছে, আর উনি, ‘পেরেছি, আমি পেরেছি’ বলে চীৎকার করে উঠছেন। লোকে বুঝছে না কি পেরেছেন। বয়েস পঁয়তাল্লিশের কোটায়, ছেলে মাধ্যমিক দেবে এবছর। নাম শঙ্কু।
এদিকে বঙ্কুবাবুর অবস্থার ক্রমশঃ অবনতি ঘটছে। বুকে প্রচণ্ড কফ জমেছে। ডাক্তার নিউমুনিয়া সন্দেহ করছেন। নিন্দুকেরা বলাবলি করছে, ‘নিশ্চয় বাড়িতে প্যারাসিটামল এক্সট্রা ছিল...’ ইত্যাদি। যা হোক, ওনাকে হাসপাতালে ভর্তি করে দেওয়া হল। অবস্থার আরো অবনতি ঘটতে ICU-তে দেওয়া হল। উনি ঘোরে। 
হঠাৎ শুনলেন কে যেন নাম ধরে ডাকছে, “ওই বঙ্কু… বঙ্কু...” চোখ মেলে তাকিয়ে দেখেন, ওনার বাবা আর ঠাকুরদা। বঙ্কুবাবু’র চোখে জল চলে এলো। তিনি জানেন, বুঝতে পেরেছেন, কেন তার পিতৃপুরুষেরা দেবলোক ছেড়ে নরলোকে তার সাথে দেখা করতে এসেছেন। তিনি তার বংশের মুখ রাখতে পেরেছেন, একটা প্যারাসিটামলও অপচয় হতে দেননি। আরে খাদ্য আবিষ্কার মানুষের এতবড় হাতিঘোড়া কিছু আবিষ্কার না। সে তো পশুপাখিও খুঁজে নেয়, মায় পেটের কৃমি কি গুয়ের কৃমিও খুঁজে নেয়। আসল হল ওষুধ বানানো। পেরেছে মানুষ ছাড়া কেউ? কেউ না। তার কদর করতে হয়। সেটা মনুষ্যজাতির কর্তব্য! উফ্… ভাবতে ভাবতে তার চোখের সামনে বিবেকানন্দের শিকাগো স্পিচ দেওয়ার মুহুর্তটা মনে পড়ে গেল। তিনি তখনই ঠিক করে নিলেন, এবারের বিজয়া সম্মিলনীতে তিনি এর উপর একটা ভাষণ দেবেন। 
হঠাৎ খেয়াল করলেন তার পিতা ও পিতামহের মুখটা যেন খুব একটা প্রসন্ন নয়। তিনি কিছু একটা বলতে যাবেন, ঠাকুরদা গর্জিয়ে উঠলেন, “হালার পোলা! আমি নিজে মইরা দেখাইলাম অমন মর্কটের মত কাজ করতি নাই, আর তোর বাপটারে দেখ, সেই ভুলটা করল! শ্যাষে কি না, বৌমার পচা ওষুধগুলান খাইয়া...” 
পিতামহ ডুকরে উঠলেন। বঙ্কুবাবুর পিতা মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে। আর তার পাশের বেডের ফোকলা বুড়োটা ফিকফিক করে হাসছে তাদের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে। 
বঙ্কুবাবুর পিতা বললেন, “তোমার কোনো কমোন স্যান্স নাই? মায়ের মুখে শোনো নাই, আমি কতগুলান এস্পায়ারী ওষুধ গিইল্যা প্রাণ এস্প্যারড করসি? আকাট মুখ্যু! ননসেন্স!” 
এরপর আরো গালিগালাজ চলল। বুড়োটাও নাকের নল পাশে সরিয়ে রেখে হেসেই চলেছে।
হঠাৎ কেমন বিকট একটা চীৎকারে ওনার ঘুম ভাঙল। মুখের কাছে ঝুঁকে মন্টি। সে বলছে, “আর ভয় নেই গো, ডাক্তার বলছেন, এই যাত্রায় তুমি বেজায় রক্ষা পেলে।” 
বঙ্কুবাবুর কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে, তবু ধীরে ধীরে ডাকলেন, “বাবু?” 
মন্টিদেবী বাবুকে ডেকে দিল। বঙ্কুবাবু তাকে ইশারায় কাছে ডাকলেন। শঙ্কু কাছে কান নিয়ে গেল। 
বঙ্কুবাবু থেমে থেমে, একটু দম নিতে নিতে বললেন, “দেখো বাবা, বাড়িতে যতই ওষুধ এক্সপায়ারী ডেটের কাছে আসুক...”
শঙ্কু তাড়াতাড়ি কথার মাঝে বলে উঠল, “আরে ওসব নিয়ে ভেবো না গো। আমি জানি। এই তো পরশু দেখলাম চুলকানির সেই মলমটার এক্সপায়ারী ডেট কাছে চলে এসেছে, অমনি মাকে না বলে, আমি সত্যকাকুদের খাটাল থেকে মাটি নিয়ে এসে বেশ করে মেখে দুপুরে ছাদে শুয়েছিলাম, ব্যস, সন্ধে হতেই মলমটা লেগে গেল!” 
বঙ্কুবাবু চোখ বুজলেন।

 
(ছবিঃ সুমন)