সকাল সাতটা নাগাদ হবে। ফিমেল মেডিক্যাল ওয়ার্ডের সামনে দাঁড়িয়ে। মা ভর্তি আছেন রেলের হাস্পাতালে। হঠাৎ দেখলাম ডাক্তার নার্স সব দৌড়াদৌড়ি করছেন।
এই সময় রেলের হাস্পাতাল ফাঁকাই থাকে। আমি মাকে খবরের কাগজ দিতে আর চা খাওয়াতে যেতাম এই সময়টা প্রতিদিনই।
আমি ঢুকে দেখলাম খুব রোগা মাঝবয়েসী একজন মহিলাকে নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছেন সবাই। মাথার কাছে দু'জন বাচ্চা দাঁড়িয়ে। মেয়েটার বয়েস বারো-তেরো হবে, ছেলেটার বয়েস পাঁচ কি ছয়। অবাঙালি। এবং দেখে বোঝা যাচ্ছিল রেলে খুবই সামান্য কোনো কাজই করেন।
মহিলা মারা গেলেন।
বাচ্চা ছেলেটা দৌড়ে বাইরে চলে গেল। পিছনে পিছনে দিদিটা। বাচ্চা ছেলেটা ড্রেনের ধারে বসে বমি করতে শুরু করল। কিছু উঠছে না, শুধু ওকে টানছে। আমার স্কুটিতে জলের বোতল ছিল। আমি গিয়ে সেটা বার করে মেয়েটাকে বললাম, ওর ঘাড়ে-মুখে দাও.... বাবা?
পিতাজী নেহি আঁতে...
বাচ্চাটাকে উঠিয়ে দিদিটা ওর মুখে জল দিল, ঘাড়ে জল দিল। নিজের ফ্রক দিয়ে ভাইয়ের মুখটা মুছিয়ে দিল। ভাইটা দিদিকে জড়িয়ে মাথাটা দিদির ওই ক্ষীণ শরীরে গুঁজে দিল।
আমি তাকিয়ে আছি। মেয়েটা আমাকে ইশারায় জলের বোতল দেখালো। আমি বললাম, থাক।
বাচ্চাটাকে নিয়ে দিদি হাস্পাতালের বাইরে গেল। ওর বস্তিতে গেল। লোকজন নিয়ে ফিরে আসবে। বেলায় এসেছিলও। ভাইটা আর দিদিটা এক কোণে গাছের তলায় দাঁড়িয়ে, বাকি সবাই খাটে সাজাচ্ছে তাদের মাকে, লরি দাঁড়িয়ে আছে, সবাই গল্প করছে। কাঁদার মত কাউকে দেখলাম না। এমনকি বাচ্চাদুটোও স্থির চোখে তাকিয়ে। বিহ্বল দৃষ্টি। জিজ্ঞাসা করে জানলাম, বাবা আসেনি, কোথাও পড়ে আছে মদ খেয়ে।
জিজ্ঞাসা করলাম, বাচ্চাটা কিছু খাবে? সামনে কেক-চায়ের দোকান আছে। কেক বা চা?
উত্তর দিল না।
এমন স্থির স্থবির নি:শব্দ হাহাকার আমি দেখিনি কোনোদিন।
আয়েন র্যাণ্ড লিখছেন না, এই যে পৃথিবীতে আমরা আসি, যেন ভাঙা মহাকাশযান থেকে পড়ে সংজ্ঞা হারিয়েছি.... জ্ঞান হওয়ার পর জিজ্ঞাসা করছি নিজেকে আমি কোথায় এলাম... কিভাবে জানব সব.... কি করব আমি এখন?
আমাদের কারোর কাছেই কোনো উত্তর নেই। সেই ফাঁকটুকু ভরাতে তাই আমাদের দর্শন লাগে, সঙ্গীত লাগে, কবিতা লাগে, ধর্ম লাগে, ছবি লাগে। আরো অনেক কিছু লাগে যেখানে আমি আমার হৃদয়ের অপরিমাপযোগ্য অনুভবদের জন্য একটা ঘর বানিয়ে দিতে পারি। যতই ভঙ্গুর হোক না কেন সে ঘর।
চাঁদের ওজন জেনে আমার গণন-তৃষ্ণার্ত বুদ্ধি তৃপ্ত হতে পারে, কিন্তু জ্যোৎস্নায় ভাসা মাঠের সামনে দাঁড়িয়ে অনুভব কিসে তৃপ্ত হয়? অনুভব কি গণনায় তুষ্ট হয়? তা কি পরিমাপযোগ্য?
মানুষ নিজে মরণশীল, ভঙ্গুর, তার সৃষ্ট যা কিছুও ভঙ্গুর, মরণশীল। হৃদয়ের তৃষ্ণা সবের সঙ্গে নিজের একটা আত্মীয়তা খুঁজতে। যেমন বুদ্ধির তৃষ্ণা সব কিছুকে একটা সুত্রের মধ্যে এনে বুঝতে।
ওরা চলে গেল। যতক্ষণ ধরে সব কাজ চলল ভাইকে নিজের হাতের বেড়ের বাইরে যেতে দিল না দিদি। ওইটুকু বেড়ের আশ্রয়ই তো প্রাণের সত্য।
আমি বেঞ্চে বসলাম। এপার ওপারের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ আছে কি না জানি না। হৃদয়ের রাজত্বকে সঙ্কুচিত করে বুদ্ধির জড়ো করা সূত্রের পর সূত্রে, তথ্যের পর তথ্যের মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ করে বাঁচাকেও সার্থক বাঁচা বলে কিনা জানি না।
আমাকে এখন ঢুকতে দেবে না। ঢুকতে দেবে আবার দুপুরে, ডাক্তার ভিজিটের সময়। মা জানেন আমি বাইরে বসে আছি। আমি জানি মা জানেন আমি বাইরে অপেক্ষা করছি। এই যে না দেখাশোনার বাইরে এক আশ্বাস.... মানুষ এটুকু সান্ত্বনা না পেলে বাঁচে কি নিয়ে? প্রাণের যা কিছু যখন শূন্য হয়ে গেল, তখন কি শূন্যের পরিধি মেপে জীবন কাটাবে মানুষ? না। জগতের সত্যে না থাক, মানুষের সত্যে তাই পরকাল বলে আছে। সেখানে সে আবার সবাইকে ফিরে পেতে চায়। তার সমস্ত ভালোবাসা শুধু রাসায়নিক সমীকরণ ছিল, এতবড় অর্থহীন জড়ত্বকে স্বীকার করে সে কি করে? সে সমস্ত বিশ্বাসটুকুকে জড়ো করে, আবার ফিরে পাওয়ার ইচ্ছায়।
জ্ঞানী বলবেন, তুমি আসক্ত, তুমি মায়ায় জড়িয়ে। আদতে সব শূন্য। বিজ্ঞানী বলবেন, সব জড়পদার্থের লীলা। তোমার আবেগেও জৈবরসায়ন বই আর কিছু নয়।
আমি কারোর কথাই শুনব না। সবাইকে প্রণাম জানিয়ে বলব, আমি জানি সংসার দুঃখময়, আমি জানি সব দুঃখের মূল আমার বাসনা, ইচ্ছা, কিন্তু সে অর্ধসত্য।
আমি জানি এ জগতে আলোছায়াময়। সবটুকুই শুধু কালো, শুধু কান্না নয়। আনন্দও আছে। আর দুঃখের মূল যদি শুধু আমার বাসনা হত তবে এত এত যুদ্ধে যে এত এত প্রাণের বলি হয়ে চলেছে রাতদিন.... সে কার বাসনার ফল?
একজন ছাত্রীকে ছাদ থেকে পড়ে মারা যেতে দেখা গেল। তার আগে তাকে নাকি ধর্ষণ করা হয়েছে, শিক্ষকেরাই করেছে এমন খবরই বেরিয়েছে। আমার অসহ্য লাগছে। মানুষের সত্ত্বায় বর্বরতা আছে জেনেও বলছি না, হ্যাঁ এটাও তো বাস্তব… একে মেনে নিতেই হবে। তা তো নয়! আমি জাস্টিস চাইছি। জাস্টিস মানবিক শব্দ। প্রকৃতি অঙ্ক বোঝে, হিসাব বোঝে, করুণা বোঝে না। অনুকম্পা বোঝে না। ন্যায় মানুষের হৃদয়ের এক পরিপূর্ণ জগতের স্বপ্ন.... প্রতিদিন তাকে সে সমাজে বাঁচিয়ে রাখতে চাইছে.... ন্যায়কে জিতিয়ে দিতে চাইছে.... ন্যায়ের উৎস হৃদয়.... যার অনুগামী বুদ্ধিবিচার।
ডাক্তারের ভিজিট হল। আশার কথা নেই, জানি। তবু দাঁড়ালাম, শুনলাম। মনকে বললাম, আজকের দিনটা আছে তো। ভাবনা কি?
মানুষ এত অল্পতেই স্বপ্ন বানিয়ে বাঁচে। তর্কে সব সমস্যার সমাধান হয় না। বাঁচার জন্য শুধু দরকার স্বপ্ন ঘিরে বাঁচার ইচ্ছাটা, সে-ই সত্য... বাকিটা তো ভবিতব্য.... ওই স্বপ্নকেই আরেক মর্মে বলে ভ্যালু.... মূল্যবোধ.... যা আমার ধীতে জাগা ন্যায়ের স্বপ্ন….তাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই….শুধু যুক্তিতে নয়… আমার হৃদয়ের শোণিত ধোয়া কল্পনায়…..
"এমন একান্ত করে চাওয়া
এও সত্য যত
এমন একান্ত ছেড়ে যাওয়া
সেও সেই মতো।
এ দুয়ের মাঝে তবু কোনোখানে আছে কোনো মিল;
নহিলে নিখিল
এতবড়ো নিদারুণ প্রবঞ্চনা
হাসিমুখে এতকাল কিছুতে বহিতে পারিত না।
সব তার আলো
কীটে-কাটা পুষ্পসম এতদিনে হয়ে যেত কালো"
~ রবীন্দ্রনাথ