রাস্তার উপরে দাঁড়িয়ে ভাই। কফি আর পকোড়া দিতে দিতে দু'বার তাকালো জুঁই। এখনই বেরোনো যাবে না। এত ভিড়। সবে বরযাত্রী ঢুকেছে। সেটা তো আছেই। দ্বিতীয় কারণ তার পোশাক। এত ছোটো জামা পরা দেখলে ভাইয়ের মুখটা বদলে যায়। সেটা দেখলে মনে অন্য কিছু করতে হবে। অন্য কিছু তো চাইলেই করা যায় না। হয় না। মন খারাপ লাগে।
ভাই বাইরে দাঁড়িয়ে। ওর টিউশানের টাকাটা নেবে। স্যার দু'বার মনে করিয়েছে। আজ না দিলে ঢুকতে দেবে না বলেছে। হয় তো ঢুকতে দেবে। তারপর ক'টা বাজে কথা বলবে।
=====
জুঁই টাকাটা দিয়ে এসে আবার দাঁড়ালো। তার দিকে ভিড় সব সময়েই বেশি আসে। এই সময় শিক্ষিত-অশিক্ষিতের পার্থক্য থাকে না। এরকম একটা দিনের জন্য সবাই অপেক্ষা করে। যখন প্রাণ ভরে তাকানো যায়। নষ্ট তাকানো। নষ্ট তাকানোতে ভর করে শরীর বেয়ে কুঁকড়ে কুঁকড়ে ওপরে ওঠে। বগলে ঘাম জমে জুঁইয়ের। আগে বেশি জমত। থাই, পা, ঘাড় শিরশির করত। জিভ শুকাতো। এখন ওসব লাগে না। অলোকদা বলে তার ফিগার ভালো। ফিগার ভালো থাকলে মেয়েদের অনেক কিছু নিয়েই ভাবতে হয় না। জুঁই বিশ্বাস করে। শুধু তারা নয়, যারা আমন্ত্রিত তারাই বা কম কিসে? অনেকেই তো দৃষ্টির নজরানা কুড়িয়ে বেড়ায়। জমায়। অ্যাচিভমেন্ট।
=====
দিদি
হ্যাঁ রে…
পড়া হয়ে গেছে। তোর কি রাত হবে? আসব? একসঙ্গে ফিরবি?
রাত অনেক। ভাই বাইরে দাঁড়িয়ে। অন্ধকার ঘেঁষে। দুটো প্যাকেট দেবে অলোকদা।
রাত সাড়ে বারোটা। জুঁই আর নিলয় ফিরছে। জুঁইয়ের পড়াশোনা ফার্স্ট ইয়ার অবধি। ভাই এইটে। মা-বাবা নেই। করোনায় মারা গেছে। বাবা টোটো চালাতো। মা লোকের বাড়ি বাসন মাজতো।
বাড়ির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে নিলয় বলল, এগুলো ফেলে দে…. চল ম্যাগি খেয়ে নিই আজ….
অন্যদিন হলে জুঁই হাসত। জানতো এটা নিলয়ের মুখের কথা না। ও নিজের খাবার ইচ্ছা সরিয়ে দিদির দিকটা ভাবছে। দিদির অপমান লাগে বলে ওর মনে হয়। আসলে জুঁইয়ের অপমান লাগে না। নোংরামি লাগে। অপমানিত লাগলে যেত না। নোংরামি লাগে বলেই যেতে হয়। যেমন মানুষ ড্রেন পরিষ্কার করতে যায়। নোংরা কাজ, কিন্তু অপমানের তো না।
ভাইয়ের মুখের দিকে তাকালো। বড় করুণ ছেলেটার মুখটা। মায়ের মত মুখটা। বিশেষ করে হাসে যখন মনে হয় মা'ই সামনে দাঁড়িয়ে। জুঁই হাতটা নিলয়ের গালে রাখল, বলল, চল্। তাই হোক।
আজ নিলয়ের কথা শুনতে ইচ্ছা করল। কেন জানে না। ম্যাগি ভালো লাগে না। কিন্তু নিলয় চাইছে যখন একবার খাক। তারপর আর বলবে না। বুঝে যাবে যে খিদের সঙ্গে মান-অপমানের সম্পর্ক জুড়ে দিতে নেই। খিদে মানে শুধু পেট ভরার ইচ্ছা না। মন ভরারও ইচ্ছা।
=====
নিলয় ঘুমাচ্ছে। জুঁই মায়ের বিয়ের অ্যালবাম নিয়ে বসে। কি রোগা দু'জনেই ছিল! বাবা, মা। শীতের রাত। স্টেশান থেকে ট্রেনের ঘোষণা শোনা যাচ্ছে। এত রাতে শুধু মালগাড়ি যায়। তাও প্ল্যাটফর্মের ধার থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা করে। কেন করে? কে এত রাতে প্ল্যাটফর্মের ধার ঘেঁষে বসে থাকে! কাবেরী সন্ধ্যেবেলাতেই ঝাঁপ দিয়েছিল। সম্পর্ক নিয়ে অশান্তি ছিল। তার ছেলেটা এখন স্কুলে যায় বাবার সঙ্গে। কাবেরীকে কেউ সাবধান করেনি। নাকি করেছিল, ও শোনেনি।
ঘুম আসছে। কাল আবার বিউটি পার্লারে কাজ। সকাল-বিকেল সাজতে আসে সব। কেন? নোংরামি ঢাকতে, না নোংরামি উস্কাতে বোঝে না জুঁই। নিজেকে এলিয়ে দিয়ে কি পায় মেয়েগুলো বোঝে না। নোংরামির একটা খিদে থাকে অনেকের। সেটা না পেলে সব তছনছ করে ফেলে মানুষ। নিজের ঘরে নোংরামি করা যায় না। যারা মাসাজ পার্লারে কাজ করে তারা আরো ভালোভাবে জানে। নোংরামির একটা খিদে থাকে। শরীরটা নোংরা করে চলে যায়। মনটা নয়। যারা দরদ দেখাতে আসে তারা অনেকেই এই ভুলটা করে। জ্যোৎস্না বলে শরীরটাকেই নোংরা করে যায়, মনটা রূপা তোর হাতে। রূপা তার স্কুলের নাম। আজকাল কেউ ডাকে না। কেউ কেউ ডাকে। মন নোংরা নিজে না চাইলে হয় না। যদি মনে হয় অবশ হয়ে করছি তখন মন নোংরা হয়। জুঁই নিজেকে বলে সে অবশ হয়ে করছে না, বাধ্য হয়ে করছে। নিজের কাছে বাধ্য। অন্য কারোর কাছে নয়। চাইলে অনেক কিছু করতে পারে। অনেক রাতে স্টেশানে গিয়ে ঝাঁপ দিতে পারে। মাসাজ পার্লারে গিয়ে অনেক রকমের কাজ করতে পারে। অনেক ধরণের নোংরা কাজ তার জানা। করতেই পারে। নিজেকে আচমকা শেষ করে দেওয়াও নোংরা কাজ। সব যায়।
দিদি….. ঘুমাসনি?
না রে… তুই?
খিদে পেয়েছে রে….
জুঁই উঠল। রান্নাঘরের মিটসেফ থেকে দুটো বিরিয়ানির প্যাকেট বার করে বলল, তুই একটু বোস, আমি গরম করে আনছি।
জুঁই আর নিলয় কেউ কারুর দিকে তাকাচ্ছে না। মালগাড়ি বাড়ি কাঁপিয়ে যাচ্ছে। এত রাতে কে সিগন্যাল জ্বেলে রাখে?
বাবা-মায়ের বিয়ের অ্যালবামটা খাটে খোলা। জুঁই একবার নিলয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, টাকাটা নিয়ে স্যার কি বলল?
নিলয় বলল, কিছু না।
নিলয় বলল, আমি কি খুব লোভী?
জুঁই বলল, না পেটুক।
জুঁই জানে খিদে শুধু পেট ভরানোর জন্য না, মন ভরানোর জন্যেও। এতে কোনো নোংরামি নেই।