Skip to main content

এত বৃষ্টি বহুকাল হয়নি। সব ভাসিয়ে নিয়ে যাবে যেন।


    পাহাড়ের কোলে ছোটো মন্দির। একটু দূরে নদী। নদী পেরিয়ে গেলেই গাঁ। পুরোহিতের গাঁ। 

    পুরোহিত প্রদীপটা নেভানোর আগে, ভালো করে আবার গোবিন্দের দিকে তাকালো। স্থির, কালো চোখ। পাথর গেঁথে এমন চোখ বানানো যায়! 

    পুরোহিত প্রদীপটা তুলে গোবিন্দের চোখের মণির দিকে তাকালো। উত্তর নেই। গোবিন্দ স্থির তাকিয়ে। অপলক। 

    দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। প্রদীপটা নিভিয়ে, মন্দিরের দরজাটা বন্ধ করে পুরোহিত চলল ঘাটের দিকে। 

    গোবিন্দ উত্তর দেয় না। তার চার বছরের ছেলেকে নিল এই নদী। কেন নিল? সে মায়ের সঙ্গে নেমেছিল স্নানে। হঠাৎ হাত পিছলে কোথায় ভেসে গেল। এত জল, এত জল। আর পেলো না কোনোদিন।

    পুরোহিত ঘাটে এসে দাঁড়ালো। উত্তাল নদী। এর মধ্যে কে পার করে দেবে তাকে? মাঝে মাঝে অনেক রাত হলেও মাঝি অপেক্ষা করে তার জন্য। আজ নেই। আজ আসবে না। ঘাটে নৌকা পাগলের মত দুলছে। যেন ছাড়া পেলেই ভেসে যাবে। হারিয়ে যাবে তো। এত জল এত জল চারদিকে। 

    পুরোহিত ফিরল মন্দিরে। দরজাটা খুলে কুলুঙ্গি হাতড়ে দেশলাইটা খুঁজল। প্রদীপ জ্বালতে থ... একি! বেদী শূন্য। গোবিন্দ কোথায়?

    সারা শরীর ভিজে পুরোহিতের। দরজা খুলে এদিকে ওদিক দৌড়ে গেল। কাকে ডাকবে? কি নামে ডাকবে? যে নাম জপের জন্য, স্থির চিত্তে মনের একান্তের, সে নাম এই ঝড়জলের রাতে চীৎকার করে ডাকবে? তাই হয়! সে ডাক তো মাধুর্যের। সে ডাক তো গোবিন্দের কাছে আত্মনিবেদনের। সে ডাক তো নিজেকে হারিয়ে ফেলে নিজেকে খুঁজে পাওয়ার। এখন কাকে খুঁজছে সে? এও কি হয়? গোবিন্দকে চীৎকার করে ডাকবে? তাও কি হয়?

    ঝড় বাড়ল। তুমুল বৃষ্টি শুরু হল। যেন পাহাড় গলে ভেসে যাবে সব। পুরোহিত চীৎকার করে ডাকছে, গোবিন্দ... হে প্রভু... গোবিন্দ... কোথায় তুমি... কই তুমি... কোথায় গেলি রে... গোপাল কই তুই... আয়.... আয়... এত জল এত জল চারদিকে...

    মাটিতে হাঁটু মুড়ে বসে হাপুস নয়নে কাঁদছে পুরোহিত। এ ডাক, এ কান্না তো মন্দিরের গোবিন্দের জন্য না... এ তো তার একমাত্র সন্তান... জলে ভেসে যাওয়া সন্তান গোপালের জন্য.. এত কান্না… এত কান্না জমেছিল... এত অভিমান… এত এত যন্ত্রণা…. গোবিন্দে গোপালে মিশে গেল সব..

    হঠাৎ হাসির শব্দ শুনল পুরোহিত। যেন পাহাড়ে পাহাড়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে হাসি। এ তো গোপালের হাসি। পুরোহিত তাকালো চমকে। বৃষ্টি থেমেছে কখন? আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ। সবুজ মাঠ ভেসে যাচ্ছে দুধেল সাদা বন্যায়। গোপালের সঙ্গে গোবিন্দ খেলে বেড়াচ্ছে সারামাঠ। গোবিন্দের পায়ের নূপুর ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হচ্ছে চারদিক। তার দিকে ভ্রুক্ষেপহীন দুজনেই। গোপাল দৌড়াচ্ছে আর গোবিন্দকে বলছে, আয় আয়... ধর ধর আমায়... আয়... গোবিন্দ ছুটে যাচ্ছে আকাশ বাতাস নূপুরের আওয়াজে রোল তুলে….

    পুরোহিত মাথা ঠেকালো মাটিতে। ভিজে মাটির ছোঁয়া লাগল পুরোহিতের কপালে। পুরোহিত বলল, কিচ্ছু হারায়নি প্রভু... কিচ্ছু না... কিচ্ছু না….

 

    মাঝি এসে ডাকল, ও পুরোহিত মশায়... উঠুন... এই জঙ্গলে শুয়ে কেন?

    পুরোহিত ধড়মড় করে উঠল। সকাল হয়েছে। কখন হল সকাল? ফ্যালফ্যাল করে তাকালো মাঝির দিকে। 

    মাঝি বলল, মন্দিরে যান…. দরজা খোলা….

    পুরোহিত হুড়মুড় করে দৌড়ালো মন্দিরের দিকে। পা টলছে। মাথা ঘুরছে। মাথার মধ্যে গোপালের হাসি আর গোবিন্দের নূপুর বেজে চলেছে। 

    মন্দিরে ঢুকল পুরোহিত, গোবিন্দের সারাটা গা ভিজে।