এটা এমনি মিছিমিছি লেখা। মনের মধ্যের কথাগুলো, চিন্তাগুলোকে বাইরে সাজিয়ে সাজিয়ে থাকে থাকে রাখা। না রাখলেও ক্ষতি ছিল না, তবু মাঝে মাঝে ভাঁড়ার ঘরের কোণে পড়ে থাকা অবহেলায় ধুলোমাখা ভাঙা সরাটা দেখলে যেমন মনটায় টুক করে একটা ব্যাথা লাগে, এও তেমন ধারা কথা।
আমি ক্লাস ফোর অবধি হাওড়ার সালকিয়ার থাকতাম। তারপর কাঁচরাপাড়ায় রেল কোয়াটার্সে। কিন্তু ফি বছর পঞ্চমী থেকে লক্ষীপূজো অবধি সালকিয়ার বাড়িতে কাটাতাম। সেখানে ঠাকুমা, ঠাকুর্দা, জেঠু-বড়মা, দিদি আর বোন থাকত।
লক্ষীপূজোর দিন সকালবেলা উঠে স্নানটান করে, পূজোয় একবার কি দুবার পরা নতুন একটা জামা পরে পূজোর ঘরে আসন পেতে বসে পড়তাম। ক্রমে ভিড় বাড়ত। পাড়ার লোকেরা কেউ না কেউ আসতেনই। দিদি হয়ত শাড়ি পড়ত। ফলে রাতারাতিই বড় হয়ে যেত। ঠাকুর্দা বসতেন প্রতিমার সামনে আসন পেতে ধুতি পরে খালি গায়ে। ঠাকুমা ঠিক পিছনেই। হাতের কাছে এটা সেটা এগিয়ে দিতেন। মা আর বড়মা নতুন শাড়ি পরে ঠাকুমার দুদিকে। সবার শাড়ি গুলোই কিরকম ফোলা ফোলা থাকত। নতুন শাড়ি অবাধ্য হয়। আঁচলের দিকে আধছেঁড়া স্টিকার।
মায়ের মুখটা পূজোর দিনগুলোতে যেন বেশি সুন্দর লাগত। বড় একটা সিঁদুরের টিপ মায়ের কপালের মাঝখানে, মাকে বেশি বেশি মা লাগত যেন। ঘরের মধ্যে ধুনোর ধোঁয়ার কুয়াশা, ধুপের গন্ধ, ফুলের গন্ধ, মাঝে মাঝে উলুদ্ধনি, সাথে ঠাকুর্দার সংস্কৃত উচ্চারণ - সব মিলিয়ে হত লক্ষীপূজো।
দরজার দিকে জেঠু বসতেন আর বাবা। কেউ এলে তাদের সাথে কথা বলা ইত্যাদির ভার তাদের উপর সেই সময়। বাবা খুব একটা কথা বলতেন না, জেঠু ছিলেন খুব জনপ্রিয় মানুষ। পূজোর ফাঁকে ফাঁকে কানে আসত বাবা জেঠুর মধ্যে রাজনীতি কিম্বা খেলা নিয়ে নানা আলোচনা। সব মিলিয়ে একটা জমাট বাঁধা নীড়। লক্ষীপূজো যেন উপলক্ষ্য।
পূজো শেষ হলে ঠাকুমা দরজা বন্ধ করে দিতেন। লক্ষী খাবেন। তারপর আমাদের ডাক পড়ত। প্রথমে ফল, মিষ্টি, চিঁড়ে মাখা। দুপুরে খিচুড়ি। সন্ধ্যে হলে মা আর বড়মার সাথে এ বাড়ি ও বাড়ি। কি খাওয়া কি খাওয়া বাপ রে বাপ! একজনের বাড়ি লুচি পায়েস হত। কি যে অসহায় লাগত। তাদের বাড়ি ছিল বেশ দূরে। ফলে তার আগে নানা বাড়ি থেকে যে পরিমাণ খিচুড়ি পাকস্থলী অধিগ্রহণ করে বসে আছে, সে আর জায়গা ছাড়বে কেন? তবু জিভ আর চোখের দিকে তাকিয়ে ঠেসেঠুসে কয়েকটা ঢোকানো।
আজ সে সব নেই। ঠাকুমা, ঠাকুর্দা, জেঠু, মা - এতগুলো ফাঁকা আসন ডিঙিয়ে লক্ষীরও বোধ হয় আসতে দ্বিধা হয়। তাই ধুপের গন্ধে, ধুনোর গন্ধে, মালা চন্দনের গন্ধে যেন শুধু নিয়মটুকুই লেগে আছে, সেই শ্রীটা আর নেই। বড়মার লক্ষীপূজো আজ যেন তর্পণতুল্য। “জানিস বাবু তোর ঠাকুমা কি অপূর্ব খিচুড়ি রাঁধতেন...তোর জেঠু যা ফাজলামি করত...তোর ঠাকুর্দা টক ফল হলে রেগে যেতে... তোর মা সব কাটাকুটি করত...”
তিনিও জানেন এ সবই আমি জানি। কিন্তু ওই যে বললুম, অতগুলো ফাঁকা আসন ডিঙিয়ে লক্ষী অবধি পৌঁছানো কি আমাদের মত গেরস্থালীর কাজ গো? তাই স্মৃতিরা ভিড় করে আসে, সংস্কৃত দুর্বোধ্য শব্দমালা কণ্ঠ থেকে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। অন্তর্যামী তখন ঘন শোকস্তব্ধ হৃদয়ের শূন্য নৈবেদ্যর ডালার সামনে নীরবে বসে। অদেখা অশ্রু পান করছেন নীরবেই।
লক্ষীর বীজ শ্রী। সৌন্দর্য্যের প্রতীক। শ্রী অরবিন্দের 'মা' বলে একটা চমৎকার ক্ষুদ্র পুস্তিকা আছে। তাতে তিনি বলছেন, লক্ষী চঞ্চলা। সঠিক সামঞ্জস্য না হলে শ্রীশক্তি জাগেন না, স্থির হন না। এ বোধ তো শুধু আধ্যাত্মিক অতীন্দ্রিয়বাদীর নয়। এ যেন কোনো কবির কল্পনা। একটানা একঘেয়ে বর্ষার শেষে যখন সন্ধ্যাকাশ বহুদিন পর সুযোগ পেল তার দয়িত পূর্ণচন্দ্রের অভিসারে সাজার, মাঠঘাট যখন কাশফুলের শ্বেতাবরণে ঢাকা, শিউলির গন্ধে চারদিক স্বর্গীয় সুধায় ভরিয়ে তুলেছে চারধার - কবি সে মধ্যরাতে আহ্বান জানালেন শ্রীকে - ইহাগচ্ছ, ইহাগচ্ছ দেবী...ইহাতিষ্ঠ ইহাতিষ্ঠ দেবী।
আজ আমার একার সংসারে যে দুর্যোগ, যে শূন্যতাই থাকুক না কেন, বিশ্বসংসারে সে অভাবের তো কোনো চিহ্নমাত্র নেই। তাই লক্ষীর আসনকে আমার বাড়ির ক্ষুদ্র ঠাকুরঘর থেকে মুক্তি দিয়েছি। ক্ষুদ্রতাতেই ক্ষতি, দ্বিধা। মহতে তা নেই। তিনি বসুন এই বিশ্বআঙিনার মাঝে কাশের আলপনায়। সব অভাব, সব অসুন্দর ম্লান হয়ে যাক। যে সামঞ্জস্যতাতে লক্ষীর অধিষ্ঠান সেই সাম্যতা আসুক ঘরে বাইরে - এই গভীর কামনা।