গতকাল থেকে তিনটে ভাষণ নিয়ে মিডিয়া তথা ফেসবুকে বহু উচ্ছ্বাস, স্তবস্তুতি শুনে আসছি। তিনটি ভাষণই বাগ্মীতায় বহু উচ্ছ্বাসপূর্ণ। বহু করতালি, বহু হাসাহাসি, বহু চিমটাচিমটি পরিপূর্ণ। কেউ আবেগের কথা বলেন, কেউ সবাই সমান হয়ে যাওয়ার সেই স্বপ্নটার কথা বলেন, কেউ মান-সম্মানের কথা বলেন।
কেউ আগাম ভারতবর্ষ পদ্মময়, কেউ লালময়, কেউ হাতময় দেখছেন।
মুশকিল হল আমরা যারা কিছুময় দেখতে চাইছি না। আমরা যারা সুবিচার, সুস্বাস্থ্য, সুশিক্ষা সর্বোপরি শান্তিময় একটা দেশের স্বপ্ন দেখতে চাইছি। তারা কোনদিকে যাব?
আমাদের কথাগুলো তো এত চীৎকার করে, নাটকীয় উপস্থাপনা দাবী করে না। আমাদের কথাগুলো তো এত জটিল নয়। চাওয়াগুলো তো এত রঙীন নয়। তবে? এত বিরোধ কেন? সবাই তো শুনেছি একটা দেশেরই মঙ্গল চায়, ভাল করতে চায়। তবে ভালো করার মধ্যে এত তফাৎ কেন? আমার বাড়ির ভাল আর তোমার বাড়ির ভাল'র মধ্যে ফারাক হতে পারে, কিন্তু আমার আর তোমার বাড়ি যে একই পাড়ায়, সেই পাড়ার উন্নতির ভাবনায় এত বিরোধ কেন?
দুর্নীতির একটা বড় অস্ত্র কুয়াশা। ‘আলুথালু করে দে মা লুটেপুটে খাই’ এমনি একটা কথা শুনেছি। স্পষ্ট চিন্তা, স্বচ্ছ যুক্তি, পক্ষপাতশূন্য মত – এগুলো জন্মাবার মত মননশীল দিশা কই? আজ বীজ পুঁতলাম, কাল ফল চাই – এই যদি পরিকল্পনা হয় তবে তো রূপকথার যাদুকর ছাড়া গতি নেই। তাই কি এত রূপকথার ছড়াছড়ি ভাষণে, ইস্তাহারে, আলাপ আলোচনায়? রূপকথার রাজপুত্তুরেরা সিনেমার হিরোদের মত ‘পারফরমার’ শুধু আজ? আঃ কি দিল! ব্যস? আর কোনো কাজ নেই?
বড় ভয় হয়। অন্ধকারকে ভয় পাই নে, ভয় পাই কুয়াশাকে। যে সংশয়ী তার তবু আশা আছে, কিন্তু যে ‘happy to be blind’ , উন্মীলিত চোখে ভাবের কুয়াশায় মগ্ন?
একটা উত্তেজনা চাই, একটা ব্রেকিং কিছু চাই, সে ক্রিকেটে হোক, সিনেমায় হোক, রাজনীতিতে হোক, ধর্মে হোক। তাতে বেশ হয়, তলিয়ে কিছু ভাবার দায় থাকে না। সবার হাঁ তে হাঁ, আর না তে না মেলালেই হল। হাজার হোক আমরা তো আর ওরা নই! ওসব শুধু বিদেশ হলেই হয়! ওসব শুধু বিদেশেই সম্ভব!
এই ‘ওসব’ আর ‘বিদেশ’ এর মত বিভ্রান্তিকর শব্দ আমি খুব কম শুনেছি। যতটা বুঝেছি, বিদেশ বলতে আমেরিকা আর ওসব বলতে যা কিছু বিনা শাসনে বিবেকপ্রসূতন্যায় ব্যবহার। ওরা জম্ম থেকেই সৎ, উদার, সৃষ্টিশীল। আমরাও হতে চাই, কিন্তু আমাদের দেশে সেটা সম্ভব কই? তাই কয়েকটা বিদেশী নীতি না হলে চলবে কি করে? ওরা ঠিক করে দিক না, কি করা উচিৎ আর কি নয়!
কথা আর কাজের সামঞ্জস্যটা প্রগতির ভিত্তিভূমি। সেটা না হলে কোনো ম্যানিফেস্টোই কোনো দেশকে সঠিক পথে নিয়ে যেতে পারে না। না জানি নিজের দেশের ইতিহাস, দর্শন, মননকে গভীরভাবে; না জানি পাশ্চাত্যেরটাও খুব গভীরভাবে। ভাসাভাসা যা জানি, তার উপর অনুমান, নিজের ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতা ইত্যাদির খিচুড়ি পাকিয়ে উত্তেজনা আর হুজুগ ছাড়া খুব বড় কিছু করে ওঠার সামর্থ্য থাকে না। কাজের কথা হলে, গভীর মননের দাবী থাকলে - অকারণ হাই ওঠে, ঝিমুনি লাগে। আর ওই একটা কথা আছে না – মাথার উপর দিয়ে বেরিয়ে যায়। আমি মাথাটা উঁচু করব না, বড় করব না, তুমি বরং কথাটাকে ছোট করে, লঘু করে আমার সামনে আনো। সেই প্রতিযোগিতাই চলছে। চলুক।
সেই বহুশ্রুত গানটা মনে পড়ছে –
এসেছি কি হেথা যশের কাঙালি কথা গেঁথে গেঁথে নিতে করতালি-
মিছে কথা কয়ে, মিছে যশ লয়ে, মিছে কাজে নিশিযাপনা!
কে জাগিবে আজ, কে করিবে কাজ, কে ঘুচাতে চাহে জননীর লাজ--
কাতরে কাঁদিবে, মায়ের পায়ে দিবে সকল প্রাণের কামনা?
এ কি শুধু হাসি খেলা, প্রমোদের মেলা, শুধু মিছেকথা ছলনা?।