Skip to main content

খুব সহজ হয়ে কাছে এসে বসেছে সে। জ্যোৎস্নায় তাকে দেখাচ্ছেও বেশ। শীত আসছে। চাদর ভিজে যাচ্ছে শিশিরে।

রাস্তা ফাঁকা। ধানক্ষেত শুরু রাস্তার ধার দিয়েই। দুজনে রাস্তার ধারেই বসে। জ্যোৎস্নায় তৈরি ছায়া বড় মায়াবী।

========

একটা ভ্যান আসছে দূর থেকে। প্যাডেলে চাপ দিয়ে চালানো ভ্যান। ভ্যানের উপর কালী ঠাকুরের মূর্তি। যে ভ্যান চালাচ্ছে সে ধীরে ধীরে শ্বাস ফেলছে। জোরে শ্বাস নেওয়ার বুকে দম নেই। জ্যোৎস্না এসে পড়েছে লাল জিভে। দুই চোখ ধানক্ষেতের দিকে তাকিয়ে। ভ্যান চালক বলল, মা এই ক্ষেত এখন বারুইদের। কি পয়সা করেছে মা ওদেশ থেকে এসে। দিনে তো ঘোরাতে পারি না। পেটের জন্য ঘুরি। রাতেই দেখ। ওই দেখ, ওরা আবার এসে বসেছে। একই চাদরের তলায়। ওরা দুইজন গলায় দড়ি দিয়েছিল একই গাছের ডালে, মনে আছে মা? সেবার পুজোয় তোকে নতুন নথ গড়ে দিলাম। আমার ছেলেটা ক্লাস ফাইভে উঠল। মনে আছে?

======

বলাইকাকা ভ্যান নিয়ে আসছে। ভয় পাবে আমাদের দেখে?

নাহ্, বলাইকাকা সে মানুষ নয়। ডাকলে সাড়াও দেবে। ডাকব?

এই কাকা….আসবে? বসবে একটু? কথা বলব। দরকারি না গো। এমনিই। বসবে?

======

মা, ডাকছে আজ। কোনোদিন ডাকে না। কিন্তু দেখো আজ আমার হাত ফাঁকা। কি দেব ওদের? মিষ্টিও নেই। যাই, কি বলো?

বলাইকাকা, ভয় পাও আমাদের দেখে?

না গো…. শরীরই তো ছেড়েছ, মন তো নয়। মন কি ছাড়া যায়? আমার মায়ের দিকেই দেখো। শরীর তো মাটির। কিন্তু মা বলে ডাকো, ওই মাটিই তোমার ডাকে সাড়া দেবে। কথা বলবে। মনের কি শরীর হয় গো?

তাও ঠিক। ওকে কি সুন্দর লাগছে দেখো…. যেন জ্যোৎস্নাও তাকিয়ে আছে ওর দিকে দিগন্তে যাওয়ার পথ ভুলে… আমি কবিতা লিখতাম জানো কাকা? জানো? সব ওর জন্য। সে খাতা ওরা পুড়িয়ে দিল কাকা।

কবিতা কি পোড়ানো যায়.. কালির হরফ পোড়ানো যায়… সে কবিতা কি তুমি চাইলেই ভুলতে পারো?

ওর কথা ছাড়ো তো…. সে কবিতা আমার শুনে শুনে এমন মুখস্থ যে আমি যদি গলায় দড়ি না দিয়ে লাইনে কাটা পড়তাম, আমার সে কাটা শরীরও মুখস্থ বলে যেত….. তোমার মাকে ভ্যান থেকে নামাবে না? এই শিশিরে পা ভিজিয়ে হাঁটবে না মা?

কিরে বেটি…. নামবি?...

নামবে না গো। বলে আমাদের কথা শুনছে। শুনুক। তোমরা কি আজ এখানেই বসে কাটাবে রাত?

না গো। বাউল গান শুনতে যাব।

কি আশ্চর্য… আমিও তো ওখানেই যাচ্ছি… মাকে বলিনি…. তবে বেটি ঠিক বুঝেছে…. মাঝে মাঝেই গুনগুন করে গাইছে…. বাউলের সুর….. চলো, যাবে এখন?

=======

ভ্যান চলছে। মায়ের দুপাশে বসে দুজন। পা ঝুলিয়ে। দুজনের হাত ধরে রেখেছে দুজনে।

বলাই বলল, বড় কষ্ট পেয়েছ না গো?

মরেছি বলে? না গো। বেঁচে থাকতে কষ্ট পেয়েছি আরো। ভালোবাসাকে বিকিয়ে দিয়ে বাঁচা যায় বলো? বাকি যা কিছু সব বেচা যায়। ওর গায়ে যেদিন ওরা হাত দিল, ওর পিঠে, গালে, থাইতে যেদিন কালশিটে পড়ল, সেদিন আমি ঠিক করলাম, বেঁচে একসঙ্গে নাই থাকতে পারি…মরতে তো পারি….

আরেকজন বলল, তুমি কি আমাদের পাপী ভাবো বলাই কাকা….

বলাই বলল, আমি? আমি কে গা? দাড়িপাল্লা, না বাটখারা? তোমরা যা করেছ ভালোবাসার জন্য করেছ। বেশ করেছ। লোভের জন্য বাঁচার চাইতে, ভালোবাসার জন্য মরা পুণ্যের। আমার বিচারের ধার কম। বুঝের খাই বেশি। আমি বুঝি। তোমাদের গায়ে একটা নোনতা স্বাদ আছে। কান্নার জলে নোনতা। জানি। মা-ও জানে।

তোমার মা আমাদের সঙ্গে কথা বলবে কাকা?

======

বাউলের গান শোনা যাচ্ছে। নূপুরের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। একতারার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। গান হচ্ছে। কথা বোঝা যাচ্ছে না। দু একজনকে রাস্তায় দেখা যাচ্ছে। সব গান শুনতেই যাচ্ছে।

রাস্তার একজন বলল, কি হে বলাই…. মাকে নিয়ে গান শুনতে এসেছ… বেশ বেশ…. তা আমাকেও নাও… আর হাঁটতে পারি না…..

ভ্যানে বসা দুজনের একজন বলল, কাকা, এই ওর থাইতে গরম কয়লা ধরেছিল….

বলাই বলল, মা ওকে সাপে কাটুক…..

ভ্যানের আরেকজন বলল, না কাকা…. ও বাঁচুক…. জ্যোৎস্না ওকে ছুঁচ্ছে না…. ভালো করে তাকিয়ে দেখো….. এর চাইতেও বেশি শাস্তি দেবে ওকে!

বলাই হাসল। বলল, তুই যে আমার মা বেটির মত কথা বলিস!