এমন জল্লাদের মত ঠাণ্ডায় আমার কোনো সুখ নাই। হেঁটে ফিরছি। বড় মাঠ। ধোঁয়াশা আর কুয়াশায় মাখামাখি। চাদ্দিকে কিচ্ছু দেখা যায় না। গাড়ির হেডলাইটগুলো দেবলোক থেকে আগত বাণীর মত মাঝে মাঝে হুস হুস করে বেরিয়ে যাচ্ছে। বাঁদিকে বাঁশবন। ডানদিকে মাঠ।
বাঁশবনের পাশ দিয়ে আসছি, শুনি কি খটাখট আওয়াজ। হাওয়া বাতাস নেই। আওয়াজ হয় কোদ্দিয়ে?
"চা খেয়ে ফিরছেন দাদা"?
বুঝলাম। তেনারা।
বললাম, হ্যাঁ। তা আছিস কেমন তোরা? অনেকদিন দেখাসাক্ষাৎ নেই!
"আর কেমন আছি। এই ঠাণ্ডায় ছেলেমেয়ে নিয়ে কি ভালো থাকব দাদা। আপনারা ভাবেন আমাদের শরীর নেই তাই ঠাণ্ডা বোধও নেই। কিন্তু এই সুক্ষ্ম শরীরে ঠাণ্ডা যে কি রন্ধ্রে রন্ধ্রে বেঁধে দাদা!"
তা তো বটেই…
"আজকাল আপনাদের জগতে খুনের টেকনিক বড় বদলেছে দাদা। আগে গলা কেটে, গুলি করে, ছুরি মেরে, গলা টিপে, বিষ দিয়ে মারত। এখন এমন পিস পিস করে নদীনালায়, মাঠেঘাটে ফেলার কি হিড়িক উঠেছে বলুন। সব জোগাড় করে গোটাগুটি আত্মাকে বানানো কি চাট্টিখানি কথা দাদা!"
আহা সে সব কথা কেন… ঠাণ্ডা নিয়ে কথা হচ্ছিল সেই তো বেশ… কিন্তু তোরা শিফট হবি বলছিলি না?
"নাহ, এই ভালো। তা দাদা বলছিলাম কি যে একটা কফি মেশিন লাগানোর ব্যবস্থা করে দেন না আমাদের…. এই উপরের লাইনে হুক করে চালিয়ে নেব।"
দেখি পঞ্চায়েতে কথা বলে… গেলবার গরমে তোরা দুটো দোলনা লাগিয়ে দিতে বলেছিলি, তা লাগানো হল, দেখলি তো… আমি কথার খেলাপ করি না… কিন্তু কফি মেশিন… কারেন্টের ব্যাপার আছে.. তাছাড়া দুধ, চিনি, কফি… পাবি কোদ্দিয়ে?
"সে না হয় আমরা জোগাড় করে নেব। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ওই দোলনা নিয়ে। দিনের বেলায় বাচ্চাগুলো একটু দোল খেলেই আপনারা যা করেন! কেউ দাঁত লেগে রাস্তায় পড়ে, কেউ গাড়ি উলটে হাত পা ভাঙে। কেউ রাম রাম করে এমন পাগল করে যেন আমরা রাবণের বংশধর। কেন রে? এই তো দুদিনের ফারাক। শেষে সব তো এদিকে এসেই জুটবি…তখন?"
আসি বুঝলি… বড্ড ঠাণ্ডা…
"ও কিছু বলবে.. কই গো.. এদিকে এসো… দাদা চলে যাচ্ছেন যে.. কই গো এসো…"
মিহি কণ্ঠ ভেসে এলো একটা….
"বলছিলাম কি দাদা…. মেয়েটার বিয়ের কথা চলছে… জল্পনা বলে যে বিয়ে বাড়িটা আছে ওটা দেখবেন আমাদের জন্য…
কবে?
"এই তো চৌঠা ফাল্গুন"
অ্যাঁ! ওইদিন তো আমাদের পঞ্চায়েত প্রধানের ছেলের বিয়ে…
খিলখিল করে কে হেসে গেল… আরো মিহি কণ্ঠ…..
"ওই তো দাদা ওই…."
আমার জিভ জড়িয়ে গেল… কিন্তু মানুষে… ইয়েতে…. নিকে… থুড়ি বিয়ে হয় নাকি…
"উফ, কি যে বলেন। মাঘের এগারো তারিখেই তো ও এদিকে চলে আসবে…."
মানে?!
আমার গলার আওয়াজে বাঁশপাতায় কাঁপন ধরে গেল। থরথর থরথর।
"সে সব মানে আপনার বুঝে কাজ নেই দাদা। আমরা সব জানি। মানুষের জীবন দাদা এই চাঁদের মত, কৃষ্ণপক্ষ আর শুক্লপক্ষ। এদিক আর ওদিক। আপনারা যেমন চাঁদের আসা-যাওয়ার হিসাব জানেন…. আমরাও এদিকে এলে মানুষের আসা-যাওয়ার হিসাব জানি"
মানে আমারটাও?!
"জানি। তবে আমাদের একটা ধম্মবোধ আছে, আমরা তাকে জানাই না। যদ্দিন চাঁদ আকাশে তদ্দিনই এই জ্যোৎস্নার মধ্যে সুখদুঃখের খেলা দাদা…. কেন ভাঙব… খেলুন… খেলুন"
আমি কি আবেশে হাঁটতে শুরু করেছি। পিছন থেকে মিহিগলা এলো…."একটু দেখো জেঠু…. হলটা ক্যান্সেল না করে যেন"...
আচ্ছা….
হাঁটছি। মাথার উপর চাঁদ। চাঁদের আলোয় রাস্তার উপর পাতার ছায়া যেন মোজাইক করা মেঝে। পাতা দুললেই ছায়া দুলছে। সব দুলছে। সব সরে সরে যাচ্ছে। পদ্মাপাতায় জল, কতক্ষণ আর দাঁড় করিয়ে রাখবে ওরে মন…. এদিক আর ওদিক…
চোখের কোলে বরফ জমছে যেন। ঠাণ্ডা শীতল। এমন জল্লাদের মত ঠাণ্ডা আমার ভাল্লাগে না! একটুও না! জীবন একটু উষ্ণ হও না কেন?
"কে যায়? এদিকে আসুন না দাদা… উষ্ণ করে দিচ্ছি…"
পাঁচু। ঝোপের মধ্যে আধশোয়া। সামনে বোতল। গ্লাস।
কিরে পাঁচু…. এখানে তাই বলে… এই শীতে?
"কি করব দাদা… বাড়িতে খেলেই মা-মেয়ে এমন খিঁচাইন শুরু করবে… আপনি এক চুমুক দিয়ে যান না দাদা….. পাঁচু নিজের টোটো করে ছেড়ে দিয়ে আসবে…. আসুন"
পাঁচু ওগুলো গিলিস না…. যা বাড়ি যা…
কানের কাছে আবার হিমেল কণ্ঠ। "ওর আর দুদিন…. দিন না দাদা খেতে…. যার যাতে সুখ…. কেন কাড়বেন…. যান যান"।
এগোতে শুরু করলাম। সব চিন্তাভাবনা ঝুরঝুর করে সামনে ঝরে যাচ্ছে। সামনেই পাঁচুর বাড়ি। দরজায় তালা ঝুলছে। নিশ্চয়ই মেলায় গেছে। সুখ সুখ। হায় রে সুখ। বাসনা। অন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু এমন বৈরাগ্য এই শীতে মোটেও ভালো না। বাড়ি থাক। মেলায় যাই। ভিড় চাই। মানুষের উষ্ণতা। যদ্দিন পাই। এইটুকুই তো চাই। এমন জল্লাদের মত ঠাণ্ডা আমার পোষায় না।