"Envy is the ulcer of the soul.” ~ Socrates
এক নিটোল কুয়াশার মধ্যে গাড়িটা এসে যখন দাঁড়ালো, আমি পা রেখে দাঁড়ালাম কুয়াশার মধ্যে, আমার মনে হল জানো, তোমাকে খুঁজতে, তোমার সঙ্গে একান্তে সময় কাটাতে আমার এখানে না এলেও হত।
তারপর পাহাড়ের বাঁকা পথ ধরে, পাইন গাছের জঙ্গলের ভিতর দিয়ে আমার ট্রলিটা নিয়ে যখন হোটেলের ছেলেটা সামনে সামনে হাঁটছিল, আমার মনে হল, আমাকে সুখী হতে আসলে কেউ বাধা দেয়নি জানো, আমিই আমাকে সুখী হতে দিইনি।
======
কটেজে ঢুকলাম। আমার স্বভাবমত আগেই টয়লেটে ঢুকলাম, চেক করার জন্য, সব ঠিক আছে, সেই রঙিন ছাদের ভিতর দিয়ে বিকেলের পড়ন্ত আলো এসে পড়েছে, সব আগের মত জানো, সব। পার্থক্য, আমি ভীষণ শান্ত হয়ে গেছি। নাকি থেমে গেছি, ক্লান্তিতে? জানি না।
একটু গুছিয়ে নিই। সারারাতের ট্রেন জার্নি তো।
"এক কাপ কফি ভেজ দিজিয়ে, শক্কর কম"।
====
বৃষ্টি শুরু হল জানো। কফিমাগটা দুই চেটোর মধ্যে যে ওমটা তৈরি করছে, সেটা মন খারাপের, না সুখের বুঝছি না।
আসলে কি জানো, সারাটা জীবন আমাকে চালালো একটাই বিষ - ঈর্ষা। আমি যা যা চাইলাম, আসলে ঈর্ষায় চেয়ে গেলাম আজীবন। আমার নিজের যে কি চাওয়ার ছিল জানলামই না। অথচ সেটা জানলেই জীবনটা কত সহজ হত, না?
যেদিন, যে মুহূর্তে এটা উপলব্ধি করলাম, সেদিন থেকে আমি শান্ত হতে শুরু করলাম জানো। আমি এবারে একটাও নতুন কিছু আনিনি, সব পুরোনো জামাকাপড়। আমি আমার সব পুরোনো যা কিছু, তার থেকে ঈর্ষাকে সরিয়ে সরিয়ে দেখতে চাইছি, আসলে আমি নিজে কি চেয়েছিলাম।
=====
ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। এই ডিনার সেরে বাইরে এলাম। মাথাটা থান ইঁটের মত শক্ত হয়ে আছে জানো। হয় তো প্রেসারটা বেড়েছে। ঘাড়ের কাছটা টাটাচ্ছে। আমি আমাদের সেই পুরোনো জায়গাটায় বসে। এক আকাশ তারা। ওরাই এখন আমার সঙ্গী, সাক্ষীও। এখানে বসে বসে আমি তোমাকে একের পর এক অভিযোগের কথা বলে যেতাম। আমি যে খুব মন থেকে ওসব বলতাম তা নয় জানো, হ্যাঁ জানি তুমি জানো। আমার মনে হত আমি সব সময় অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। সবার উপর রাগ হত। রোদ, জল, আকাশ, সময়, বাড়ির পাঁচিল, দেওয়াল, ছাদ…. এমনকি তুমিও… আমার মনে হত আমি যেন অনেক কিছু ডিজার্ভ করি, তোমরা সবাই আমাকে ঠকাচ্ছ, কারণ আমি বুঝতে পারছি না আমার আসলে কি চাই বলে।
দেখো, আজ এসব কথা ভাবতে ভাবতে চোখের কোণায় জল এলো। সেদিনও আসত। ক্ষোভে। আজ এলো নিজের উপর করুণায়। কি ভাবে নষ্ট করলাম সব। নিজের উপর যে এতবড় একটা ছায়া পড়ে আছে টেরই পেলাম না! ঈর্ষার এত আপনত্ব জাগানোর ক্ষমতা! আপনত্ব… কি বাংলা বলছি…. তুমি বুঝছ নিশ্চয়ই…..
=====
ঘুম থেকে উঠলাম পাঁচটা পনেরো নাগাদ জানো। তুমি হাঁটতে চলে যেতে। আমি উঠে বাইরেটায় বসতাম।
আজ আমি হাঁটতে এসেছি। এখন যেখানে দাঁড়িয়ে সেখান থেকে সূর্যকে দেখছি। আজকের সূর্য। কি কৃতজ্ঞ লাগে জানো এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কাছে নিজেকে। আমি আবার আমাকে ফিরে পেয়েছি বলে নয়, তুমি আমাকে ছেড়ে গিয়েছিলে বলে। তুমি ছেড়ে না গেলে হয় তো আমি আমাকে কোনোদিন খুঁজে পেতাম না। ঈর্ষা বড় অবলম্বী জানো। সে আমাকে অবলম্বন করেছিল, আমি তোমাকে। যেদিন আমাকে আমার স্পষ্ট, স্বচ্ছভাবে নিজের সঙ্গে বোঝাপড়ার দিন এলো, সেদিন আমি দেখলাম ওকে…. ততদিনে সে ক্যান্সারের মত আমার স্বভাবের সবটুকু জুড়ে বসেছে। ভাবলাম আমার মুক্তি নেই হয় তো আর আমার থেকে। কিন্তু পারলাম জানো, কিসের জোরে পারলাম জানি না। হয় তো তোমার আমার উপর যে একটা নিঃশর্ত আস্থা ছিল তার জোরে…. কিম্বা হয় তো মানুষ সত্যিটা জেনে গেলে তার জোরেই নিজেকে টেনে বার করে আনতে পারে…. জানি না….
======
আজ দুপুর থেকে বৃষ্টি। আমি তবু এসেছি ঝরণাটার কাছে। এখানে একটা সিমেন্টের পাকা ছাওনি করেছে জানো। ঝরণার শব্দ, তার সঙ্গে ঝড়বৃষ্টির শব্দ…. একটা হুলুস্থুল হচ্ছে। আমার তোমার শরীরের উষ্ণতা, তোমার চোখের আশ্রয়, তোমার ঠোঁটের আলাপ…. সব চাই। এখনই চাই। এত বড় বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে তুমি কেন, কেউ আমাকে এতটা একা করে যেতে পারে না…. সে অন্যায়…. আমি এতটা একাকীত্ব কি ডিজার্ভ করি বলো… আমার পাঁজর ঠেলে, গলা ঠেলে এই যে কান্না বেরিয়ে আসছে….
আমি সামলে নিচ্ছি আমাকে। এটা আমি পারি। পারতেই হয়। দু-একজন টুরিস্ট আছে, খেয়াল করবে না…. আমার সানগ্লাসে, আমার মুখে বৃষ্টির, ঝরণার জলের ছাঁটে সব ঢেকে যাবে…..
তুমি চলে যাওয়ার পর দু-একজনের ভালোবাসাকে মানতে চেষ্টা করেছি জানো। শরীর আধজাগা হয়ে, মন বিভ্রান্ত হয়েছে। আমি গ্রহণ করতে পারিনি। ওসব থেকে বেরিয়ে এসেছি তাই।
এই যে ঝড়বৃষ্টি ঠেলে উপরের দিকে উঠছি, এই যে আমার একদিকে গভীর খাই…. আমার পা পিছলে গেলে…..
তবু ভয় নেই। সাবধানতা আছে। আমি এতদিনে জেনেছি ভালোবাসা মানে সবটুকুকে গ্রহণ করে নেওয়া। তুমি পেরেছিলে। আমি পারিনি। কারণ আমি চেষ্টাই করিনি। সবটুকু আমি ঈর্ষার কাছে বন্ধক দেওয়া ছিলাম যে।
এখন আমি নিজেকে গ্রহণ করতে শিখেছি। তোমাকেও। আমাদের ব্যর্থ হওয়া সম্পর্ককেও।
====
একটা দোকানে এলাম। থুপকা আর চা অর্ডার করে বসে আছি। জানলার কাঁচ বৃষ্টির জলে ঝাপসা। দিনের আলো কমে আসছে।
আমি যেদিন শুনেছিলাম তুমি ভেন্টিলেশানে, আমি জানতাম তুমি আর ফিরবে না। তখন তো মৃত্যুমিছিল সারা পৃথিবী জুড়ে। আর সেখানে তুমি আমি পৃথিবীর দুই গোলার্ধে।
তবু ক্ষোভ হয়নি। কারণ আমাকে ছেড়ে গিয়ে তুমি এগারোটা বছর নিজের মত কাটাবার সুযোগ পেয়েছিলে। আমাদের যোগাযোগ ছিল নিয়মিত। পাশে থাকতে আড়াল ছিল অনেক। দূরে গিয়ে সে আড়াল গেল ঘুচে। বরং দূরে গিয়ে আমরা কাছে এলাম আরো বেশি। তখন আমার ভিতরে অল্প অল্প ধরছে ভাঙন।
মানুষের মধ্যে ঈর্ষা থাকে কম-বেশি। কিন্তু আমার বেলায় সেটা বিকারের পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। কেন বলো তো? আমি দুর্বল ছিলাম বলে? নাকি আমার বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার মা-বাপির ক্ষোভগুলো ওরা আমার মধ্যে চারিয়ে দিয়েছিল বলে? নাকি তুমি?
====
রাত বারোটা। আমি নিখিল ব্যানার্জির 'শ্রী' শুনছি।
আমার মনে হয় তোমার মধ্যে একটা ইনিফেরিওরিটি কমপ্লেক্স ছিল। যাকে তুমি নিখুঁতভাবে আড়াল করে রাখতে তোমার কপট বিনয়ে। আমার মধ্যের জ্বলন্ত ঈর্ষা হয় তো তোমাকে কোথাও আরাম দিত। তোমার মধ্যের অক্ষম ক্ষোভ হয় তো আমার ঈর্ষাকে অবলম্বন করে সান্ত্বনা খুঁজত। নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখত? তুমি আমায় প্রশ্রয় দিয়েছিলে আসলে। আমাকে গ্রহণ করেছিলে সেই গোপন উদ্দেশ্যে। আমাকে ভালোবেসে নয়।
তারপর যখন দেখলে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি আমারই ঈর্ষার সঙ্গে লড়তে লড়তে…. তুমি বুঝেছিলে ভাঙন আসন্ন…. তাই সরে গিয়েছিলে। নিজেকে বাঁচাতে। নিজের অতিযত্নে রাখা ইনফেরিওরিটির জটিলতাকে বাঁচাতে।
আসলে আমরা নিজেদের কাছেই ভীষণ অসহায়। তাই না?
=====
ট্রেন লেট। আমি স্টেশানে বসে। অনেক অনেক মানুষের ভিড়। আমি আমাকে পুরোনো জামাকাপড়ে ঢেকে। পুরোনো আমি-কে কোনোভাবে নতুন সাজে না সাজিয়ে বসে। তাড়া নেই। যার যা আছে থাক। আমার যেটুকু আছে তাতে আমার জীবন চলেই যাবে। আর না গেলেই বা কার কি আসে যায়? এইটুকু সত্যি বুঝতে আমার জীবনের এতগুলো বছর গেল।
সত্যিই জানো, আমাকে সুখী হতে কেউ বাধা দেয়নি, এক আমি ছাড়া…. আমার ঈর্ষা ছাড়া….. অন্যের চাওয়াকে নিজের চাওয়া করে বাঁচা ছেড়ে দিয়েছি…
এখন অপেক্ষা করছি আমার শোয়ার মিডল বার্থের… পিঠটা বড্ড টাটাচ্ছে….. সিটটা ভালো ছিল না গাড়িটার….