Skip to main content

1

 

আমি অ্যাদ্দিন কুমীরের রচনা গল্প শুনে এসেছি। এই প্রথম প্রত্যক্ষ করলাম। সেই যে গো গল্পে আছে না, ছাত্রকে যা-ই লিখতে দেওয়া হয় অমনি সে কুমীরের রচনা লিখে ফেলে। তা হল কী, শিক্ষক দিলেন পলাশীর যুদ্ধ রচনা। ভাবলেন এবারে দেখি সে কী করে কুমীরের রচনায় এনে ফেলে। কিন্তু শিক্ষককে এক্কেবারে তাজ্জব করে দিয়ে ছাত্র লিখল, “সিরাজদ্দৌলা বললেন, মীরজাফর, তুমি এ কী করলে? এ তো খাল কেটে কুমীর আনলে!” ব্যস শুরু হয়ে গেল কুমীরের রচনা।

মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেবকে নিয়ে পড়াশোনায় আমার কিঞ্চিৎ আগ্রহ আছে বলে আমার এক বন্ধু এবারের ‘কৃত্তিবাস’ সংখ্যাটা নিয়ে এসে আমার হাতে দিল। তাকে আকর্ষণ করেছে বইটার উপরে মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেবের ছবিটা।

যা হোক, বইটা হাতে নিয়ে পাতা উল্টাতে লাগলাম। সূচীপত্র দেখে দেখে যে বিষয়টায় চোখ আটকালো তা হল ‘সাহিত্য ও মনস্তত্ত্বে চৈতন্যের উদ্ভাস’। মোহিত কামাল লেখক।

পাতা উলটে দেখলাম লেখাটায় রবীন্দ্রনাথ, ফ্রয়েড ও নজরুলের ছবি পাশাপাশি আছে। ভাবলাম বাহ! এতো দারুণ ব্যাপার। রবীন্দ্রনাথ আর নজরুলের চেতনায় চৈতন্যদেবের প্রতি অনুরাগ, প্রভাব থাকবে সে স্বাভাবিক। কিন্তু ফ্রয়েড?! তাজ্জব ব্যাপার!

অতি আগ্রহে পড়তে শুরু করলাম। লেখক শুরুতেই রবীন্দ্রনাথের ‘পোস্টমাস্টার’’ গল্পের শেষ কয়েকটা লাইন তুলে ‘চেতনা’ র বিশ্লেষণ করলেন। তারপর ফ্রয়েডের ইদ, ইগো, সুপারইগো এইসব পড়ে ফেললাম। নজরুলে কবিতায় ‘অচেতন চিতে চেতন’ ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা পড়ে ফেললাম। কিন্তু মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য কই? নাই নাই নাই। ওই কুমীরের রচনা হয়ে গেছে। যেহেতু নামটা ওঁর শ্রীচৈতন্য, তাই চেতনা। মানে ফ্রয়েড ইত্যাদি।

এখন দেখুন, ধর্ম নিয়ে দুই ধরণের আলোচনা হয়। এক, স্কলারদের আলোচনা, যা পাণ্ডিত্যপূর্ণ। আর হয় ভক্তিপূর্ণ আলোচনা। দুই-ই দুই ধরণের রসের সঞ্চার করে। কিন্তু এমন শব্দ নিয়ে ছেলেখেলাটাকে কোন গোত্রে ফেলব? যদি বইটার শুরুতে মহাপ্রভুর ছবি না থাকত, শুধু “চৈতন্য” শব্দটা থাকত, তবে বুঝতাম যে এ চৈতন্য নানাবিধ চৈতন্য। কিন্তু শ্রীচৈতন্যর সঙ্গে এ চৈতন্যর মিল কোথায়? ইস্কন বলে যে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান আছে তারাও চেতনা শব্দটা ব্যবহার করেছেন, কিন্তু সেকি সত্যিই মনোবিজ্ঞানের চেতনা? পাঠককে বিভ্রান্ত করা না?

আরো একটা কথা আছে এখানে। কিছুটা অপ্রাসঙ্গিক হলেও বলা যায়। মনোবিজ্ঞানের যে চেতনা, সে নিয়ে ভারতের ভক্তি আন্দোলন না, ভারতে আরেক ধরণের অধ্যাত্মিক জাগরণে খানিক আলোচনা হয়েছে। রমণ মহর্ষি যার বিশাল স্তম্ভ একজন। এমনকি বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী কার্ল ইয়ুং অবধি তাঁতে প্রভাবিত হয়েছিলেন শুধু না, রমণ মহর্ষিকে নিয়ে একটা লেখায় নিজে ভূমিকা অবধি লিখে দিয়েছিলেন। ভারতের সেই অধ্যাত্মিক চর্চার ধারাকে বলে জ্ঞানমার্গ। এ পত্রিকা যদি রমণ মহর্ষিকে নিয়ে হত তবে না হয় সেই মনোবিজ্ঞানের চেতনা আর অধ্যাত্মবোধের চেতনার মধ্যে একটা যোগাযোগ স্থাপনের ক্ষীণ রেখা টানার চেষ্টা করা যেত।

সব শব্দেরই একটা শব্দার্থ আর মর্মার্থ হয়। শ্রীচৈতন্যদেবের নামের চৈতন্য, শ্রীরামকৃষ্ণ কথিত “তোমাদের চৈতন্য হোক”, কগনিটিভ সায়েন্সের চৈতন্য, মনোবিজ্ঞানের চৈতন্য, সাহিত্যে নানা জায়গায় উল্লিখিত চৈতন্য শব্দ…. সব শব্দই চৈতন্য, কিন্তু মর্মার্থে যোজন যোজন দূরত্ব।

মহাপ্রভুর নামে পাঠককে ডেকে এমন বিভ্রান্ত করে দেওয়া কি সম্পাদক মশায়ের বিধিসম্মত কাজ হল একটা? লেখা কেমন, সে নিয়ে আমার প্রশ্ন না। কিন্তু আমার প্রশ্ন হল এ লেখাটা এই অনুষঙ্গে আসাটা কি আদৌ সঙ্গত?

2

3

Category