বেশ কিছু বছর আগের কথা। শিয়ালদা থেকে কোনো একটা আপ ট্রেনে উঠেছি। বাড়ি ফিরছি, কাঁচরাপাড়ায়। সকাল এগারোটার আশেপাশে হবে। বর্ষা কাল। লাগাতার বৃষ্টি হচ্ছে কয়েকদিন ধরে। ফাঁকা ট্রেন। আমি দু'পাশের জানলা থেকে বেশ কিছুটা সরে মাঝামাঝি বসলাম। ট্রেন ছাড়ল। আমি একটা বই বার করে পড়তে শুরু করলাম। ট্রেন এগোতে লাগল আর ভীড়ও আসতে আসতে বাড়তে লাগল।
আগরপাড়া থেকে একটা পরিবার উঠে আমার পাশের সিটগুলোতে বসল। বয়স্কা মা, তাঁর ছেলে, ছেলের বউ আর দুই নাতি। ছেলে দুটির বয়স বছর দশের মধ্যেই হবে।প্রতিদিনের খেটে খাওয়া পরিবার। প্রত্যেকে তাঁদের বহু ব্যবহৃত একটাই ভাল পোশাক পরেছেন বলে মনে হল। শুধু বাচ্চা দুটোর গায়ে নতুন দুটো জামা। আশ্চর্য হলাম ভদ্রমহিলার পুত্রবধূর মুখে চোখ পড়তে। আমার খুব নিকটাত্মীয়ার সাথে অদ্ভুত মিল। চোখ নামিয়ে বইতে আনলাম আর ভাবতে লাগলাম এত মিলও হয়!
যা হোক ইতিমধ্যে ভীড় বেড়েছে আর বাচ্চা ছেলেদুটোর চীৎকারে পড়া মুলতুবি রেখে জানলার দিকে চেয়ে বসে থাকলাম। বর্ষাস্নাত মেঘলা বেলা চারিদিক, মনে কেমন ছুটির আমেজ তৈরি করছিল।
পাশে শুনতে পাচ্ছিলাম হকারদের আনাগোনা, বাচ্চা দুটোর ক্রমাগত বায়না আর তার সাথে বাবার প্রত্যাখ্যান।
বেশ কিছুক্ষণ পর এক লজেন্সওয়ালা উঠলেন। ২ টাকায় চারটে লজেন্স। লাল-হলুদ এই লজেন্সগুলো আমি ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি। এখোনো ক্যাডবেরি, পার্কের যুগেও এরা স্বমহিমায় নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রেখেছে দেখলে অবাক লাগে!
ভদ্রলোক কিনলেন। বাচ্চাদুটোর চোখে ঝিলিক খেলে গেল। তিনি প্রথমে একটা লজেন্স ওনার মা-কে দিলেন, একটা প্যাকেট বাচ্চা দুটোকে। আর দুটো লজেন্স নিজের হাতে নিয়ে বসে রইলেন।
বুঝলাম মায়ের সামনে স্ত্রী কে দিতে লজ্জা বোধ করছেন। ওঁর মা হঠাৎই ছোট বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে জানলার দিকে ঘুরে বাইরের অভ্যস্ত দৃশ্যকে অতিপ্রাকৃতিক করে ব্যাখ্যা শুরু করলেন। আমার হাসি পেল, হঠাৎ মাঠে চরা গরুও কি গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্য হয়ে উঠল।
তরুণী বধূটির মুখে তখন সলজ্জ হাসি। ওঁর স্বামী অতি দ্বিধায় ধীরে ধীরে সেই অমূল্য সম্পদ লজেন্সটি স্ত্রীর দিকে এগিয়ে দিলেন, বধূটি আঁচলের নীচে হাতটি এগিয়ে, সেটি নিয়ে মাথা নীচু রেখেই মুখে পুরলেন। তারপর আরক্ত মুখে যে দৃষ্টিতে তাঁর স্বামীর দিকে তাকালেন মনে হল এই ক্ষণটিকে আস্বাদন করার জন্যই বিধাতা এই সংসার রচনা করেছেন।স্বামীর মুখে তখন স্বর্গীয় পরিতৃপ্তি।
আমার সব পুর্ব চিন্তা গেল ভেসে। বাইরের মেঘলা আকাশের মত মনের কোণেও মেঘ জমল। মনে হল পবিত্র হলাম এক মুহুর্তে।
এর পরের ঘটনাটা সেদিনের।
যাচ্ছি কোলকাতায়। ডাউন ট্রেন। খুব ভীড়ে দাঁড়িয়ে। চমকে গেলাম কাঁকিনাড়া ছাড়তে। দূরের সিটে সেই বধূটি! একি চেহারা হয়েছে! আমার আত্মীয়ার সাথে মুখের মিলটিই মনে করিয়ে দিল বোধহয় সেই দিনের মুহুর্তগুলো।তাঁর সারা শরীরে পরিশ্রমের ছাপ। সিঁদুরহীন এলোমেলো চুল। ভেতরটা ছ্যাঁত করে উঠল। পারলাম না স্থির থাকতে। জানলাম ক্যান্সার যবনিকা টেনেছে আমার দেখা সেই অধ্যায়ের। আমার চারপাশের ভীড় গেল হারিয়ে। স্থির হয়ে দরজার কাছে দাঁড়ালাম। চোখ পড়ল ওঁর জানলার বাইরে তাকানো চোখের ওপর। কি শান্ত ওঁর চোখ দুটো। বুঝলাম, বিধাতা শুধু প্রেমের পাত্রটিই ভাঙতে পেরেছেন, পারেন নি একবিন্দু প্রেমের সুধা কেড়ে নিয়ে এঁকে নি:স্ব করতে। ইনি তাঁর সমস্ত শক্তি দিয়ে তা হৃদয়ে আগলে রেখেছেন মৃত্যুঞ্জয়ী তপস্যায়। ক্ষণিকের জন্য মৃত্যুকেও কি অসহায় দুর্বল বোধ করলাম এই নীরব তপস্বিনীর সান্নিধ্যে। পবিত্র হলাম।