বৃদ্ধা সামনের দরজার দিকে তাকিয়ে শুয়ে আছেন। একটু আগে আয়া অল্প একটু সেদ্ধভাত আর আর উচ্ছে আলুসেদ্ধ মাখা খাইয়ে গেছে। কুলকুচোটা ভালো হয়নি। দাঁতের ফাঁকে কয়েক টুকরো উচ্ছে আটকে এখনও। তিতো তিতো লাগছে জিভ ঠেকালে। সব মিলিয়ে আটটা দাঁত টিকে আছে এখন।
একতলা এটা। সোদপুর স্টেশান থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্ব। ট্রেনের শব্দ রাতদিন। স্টেশানের অ্যানাউন্সমেন্টের শব্দ সারাটা দিন। আগে টাইমটেবিল মুখস্থ থাকত। এখন কানে আসে না তেমন কিছু। মনও গুটিয়ে গেছে অনেক। ভাঁজের পরতে পরতে স্মৃতির বাস।
শব্দ আছে কান নেই। খাবার সব আছে, স্বাদ নেই, হজমের শক্তি নেই। মাটি আছে, হাঁটবার, দাঁড়াবার শক্তি নেই। স্কুল টিচার ছিলেন। বিয়ে করেননি। দাদা বউদির সংসারেই কাটিয়ে দিলেন। এই একতলার ঘরই গোটা জীবন। বেড়াতে ভালোবাসতেন না কোনোদিন। মনের যাওয়া বলতে দক্ষিণেশ্বর আর পানিহাটির গৌরমন্দির। মাঝে মাঝে গঙ্গার ধার।
বৌদি মারা গেলেন গত বছর করোনায়। সবারই হয়েছিল। দাদা হাস্পাতাল থেকে ফিরে এলেন, একা। তার নিজেরও হয়েছিল, তবে হাস্পাতাল যেতে হয়নি।
আজ রাখী। দাদা নামলেন না। রেলে কাজ করতেন। রিট্যায়ার করেছেন কবে। দাদা বলেন, মনেই পড়ে না বুঝলি, যেন সে গতজন্মের কথা।
দরজার থেকে ঘরের মধ্যে রোদ এসে পড়েছে। পাখার আওয়াজ, রাস্তার হাজার একটা আওয়াজ, কাকের আওয়াজ, অল্প অল্প সব কানে আসছে। সারা পৃথিবী চলছে, শুধু তাদের দুজনের জীবনটা থমকে।
বিনু….. বিনু…..
বিনু রান্নাঘর থেকে সাড়া দিল, আসছি।
রান্নাঘরটা একতলাতেই। বিনু এসে দাঁড়িয়ে বলল, কি?
দাদা আসতে পারবে না, না রে?
বিনু কথা বলে হাত পা নাড়িয়ে। বিনু হাত পা ছুঁড়ে বলল, কি বলো দিদা…. বাথরুমেই যেতে পারে না…. হাঁপিয়ে যায়... বেডপ্যান দিতে হয়…. সে এতগুলো সিঁড়ি বেয়ে নামবে?...
চিত্রলেখা একটু ইতস্তত করে বললেন, আজ রাখী….
বিনু বলল, আর রাখী... রাখো তো…. বেঁচে গেছো দুইজনে এই না ঢের….
বিনু চলে গেল। চিত্রলেখার বুকটা ধড়ফড় করছে। আশ্চে বছর কে থাকবে ঠিক আছে? না না, এ বছর পরাতেই হবে… বিনু... এই বিনু….
বিনু আবার এসে দাঁড়ালো… হাতে খুন্তী... বলি রাঁধতেও দেবে না…. খাবে না নাকি... কি হল? এখন আমি কিন্তু বাইরে যেতে পারব না রাখীটাখি কিনতে… বাজারে গেলেই এসে আবার স্নান করো…. রাখীটাখি স্যানিটাইজার করো…..
সব কথা হুড়মুড় করে বলল বিনু হাত পা ছুঁড়ে। চিত্রলেখা কতবার বলেছে, ওটা স্যানিটাইজার করা না রে, স্যানিটাইজ করা…. কে শোনে…
বিনু চলে যাচ্ছিল। চিত্রলেখা ডেকে বলল, একবার কাছে আয় না মা….
বিনু এলো মাটি কাঁপিয়ে। চিত্রলেখা একটা লাল সুতো হাতে দিয়ে বলল, এটা দাদার হাতে পরিয়ে দিয়ে বলিস, আজ রাখী... এ বছরটা যেন এইটাই পরে নেয়... সামনের বছর….
গলা ধরে এলো। বিনু কথা না বাড়িয়ে, 'আচ্ছা' বলে চলে গেল। বিনুর সিঁড়ি দিয়ে ওঠার আওয়াজটা কিছুক্ষণ শোনা গেল। মিলিয়ে গেল তারপর। দুটো শালিক পাখি এসেছে ঘরে। দরজার কাছে বসে খেলছে। অল্প অল্প হাঁটছে। দাঁড়াচ্ছে। মেঝেতে কিছু খুঁটে খাচ্ছে। চিত্রলেখার দিকে তাকাচ্ছে।
বিনু এলো, হাতে চামচে কিছু নিয়ে। চিত্রলেখার মাথার কাছে এসে দাঁড়ালো... বলল, দাদু তোমার জন্য কমপ্ল্যান পাঠালো... বলল, রাখী বেশ হয়েছে…. সামনের বছর এরকম রাখী পাঠালেই….
বিনুর চোখ বেয়ে জল পড়ল শাড়িতে। গলা বুজে গেল। কোনোরকমে নিজেকে সামলে বলল, তোমরা পারোও…. আমার তো কোনো ভাই নেই…. এসব বুঝিও না….
বলতে বলতে বিনু সত্যি সত্যিই কেঁদে ফেলল... এক হাতে চিত্রলেখার মাথাটা অল্প তুলে বলল, হাঁ করো…. কেঁদো না... কেউ মরবে না তোমরা... কেউ না…
শালিক দুটো সারা ঘর ঘুরে বেড়াচ্ছে। সামনের পেয়ারা গাছের থেকে একটা কাঠবেড়ালি ক্রমাগত ডেকেই যাচ্ছে। পেয়ারা গাছের ছায়া মেঝেতে রোদের সঙ্গে মিশে লুকোচুরি খেলছে।