একটি সংবাদ পাইলাম। বিদ্যাসাগর মহাশয় কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত 'মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউট' নামক বিদ্যালয় থুড়ি স্কুলটি হইতে বাঙালা ভাষা নির্বাসিত হইতেছে। কারণ বাঙালা ভাষায় শিক্ষাগ্রহণে ইচ্ছুক বাঙালী অভিভাবক তথা ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা দুই আঙুলের কয়েকটি কড়ের অধিক আর যাইতেছে না। অগত্যা ইংরাজি ও হিন্দীভাষাকেই শিক্ষার মাধ্যম করা হইবে এমন সম্ভাবনা দেখা যাইতেছে।
অর্থাৎ বাঙালি এতদিনে আত্মত্যাগের মাহাত্ম্য বুঝিল। নিজের ভাষা সরাইয়া অন্যের ভাষাকে পথ করিয়া দিয়া বাঙালি যে উদারতার পরিচয় দিতেছে তাহা বিশ্বে সত্যিই বিরল। একটি ভাষার প্রতি আনুগত্য নিতান্তই মধ্যযুগীয় একটি মানসিকতা। যে ভাষায় বিশ্বে তৃতীয় ও চতুর্থ স্থান অধিকার করিয়া আছে তাহার কাছে ঘরের চাবিকাঠি তুলিয়া দেওয়ার মধ্যে আর যা হোক নিন্দনীয় কিছু দেখিনে। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের কোনো পুত্র সেই অর্থে সফল হন নাই, রবীন্দ্রনাথের পুত্রদের মধ্যেও কেহই আধুনিকোত্তর যুগের কাণ্ডারি হইতে পারেন নাই। বাঙালি ও তাহার ভাষা ইতিহাসের একটি গৌরবময় অধ্যায়ের অংশ নিশ্চয়, কিন্তু অধুনা সে রামও নেই সে রাজত্বও নেই। তাই অবশেষে উহার ত্যাগই বুদ্ধিমানের পরিচায়ক। এবং বাঙালি বুদ্ধিমান জাতি এই নিয়েও কাহারও কোনো সংশয় নাই। ভারতের অন্যান্য প্রদেশে তাহারা ভাষা লইয়া যে সঙ্কীর্ণতা দেখাইতেছে তাহা নিতান্তই মূঢ়তা। যে নদীতে মৎস নাই সেই নদীতে ছিপ ফেলিয়া আর কেহ বসিলে বসিয়া থাকিতে পারে, আমরা বাঙালিরা কদাপি নহি।
অগত্যা সুকুমার সেন মহাশয়ের 'বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস' বইখানিতে নতুন অধ্যায় সংযোগের প্রস্তাবনা রাখি, 'বাঙ্গালা ভাষা - ইতিহাস'। তবুও লোকে বাঙলা ভাষায় কথা বলিবে। প্রেম করিবে। কোলাহল করিবে। কিন্তু ওই ভাষায় শিক্ষাগ্রহণ করিবে না। যেমন ঠাকুরঘরের আসন আর শৌচালয়ের পাত্র বিশেষ স্থানেই ব্যবহৃত হয়, কিন্তু তাহার বাহিরে শোভা বা শুচিতা ত্যাগ করিয়া জনসমক্ষে আসে না - ইহাও সেইরূপ। তবে এই নিয়ে আমরা আন্দোলন করিব। আপন সন্তানকে ইংরাজি ভাষার পিঠে চড়াইতে শিখাইবার পর যে অবকাশ রহিয়া যায় তাহার সদ্ব্যবহার তাহাতেই হইবে।
এতদিন ধরিয়া যে লক্ষ্যে আমরা তিল তিল করিয়া অগ্রসর হইতেছিলাম, অভিনন্দন জানাই যে তাহাতে আমরা বহুলাংশে সফলতা লাভ করিয়াছি। ইহা আমাদের আজিকার দিনে কবিগুরুর প্রতি শ্রেষ্ঠ শ্রদ্ধার্ঘ্য বলিয়া আমি মনে করি। বাঙালি 'গীতাঞ্জলি' ভুলুক, 'Song Offerings' স্মরণে রাখুক। ভুলিলেও চলিবে। কিটস, বায়রণ, ব্লেক তো মরিয়া যায় নাই ছাপাখানা হইতে!
সৌরভ ভট্টাচার্য
9 May 2018