Skip to main content
001
002

মা সাহিত্যঅন্ত প্রাণ ছিলেন না। কিন্তু একটা সহজ পাঠ আমায় দিয়ে গিয়েছিলেন ভাষা নিয়ে। মানুষ আগে, ভাষা পরে। আবার প্যারাডক্সটা হল, মানুষকে আপন করতে গেলে তার ভাষাকে আপন করতে হয় আগে। এটাও শিখিয়েছিলেন।

মা-কে দেখতাম মা যার সঙ্গে কথা বলতেন, সে যে শব্দটা যেভাবে উচ্চারণ করত মা-ও ঠিক সেইভাবে উচ্চারণ করতেন। যেমন আমাদের কাজের দিদি যদি 'সীম'কে 'ছিম' বলতেন, মা-ও তার সঙ্গে কথা বলার সময় 'ছিম' বলতেন। কেউ যদি 'সন্ধ্যাকে', যেরকম সাধারণত বলি, 'সোন্ধে' বা 'সোন্ধা' না বলে এক্কেবারে 'স+অ+ন্ধ্যা' বলে, মা অমনি তার সঙ্গে কথা বলার সময় ঠিক তেমনই উচ্চারণ করতেন। যেমন আমাদের রেল কলোনিতে অনেক রাজ্যের মানুষ থাকতেন। 'সাইকেল'কে 'সাইকিল', 'প্ল্যাটফর্ম'কে, 'প্লেটফর্ম' ইত্যাদি ইত্যাদি। মা নিজের ভাষাকে বদলে নিতেন। কখন কাকে 'বিস্কুট' আর 'বিস্কিট' বলতে হবে ইত্যাদি। এই নিয়ে মায়ের সঙ্গে প্রচুর মজাও হত। প্রচুর ঠাট্টা হত। মা বলতেন, যা তো! বেশি বিদ্যা ফলাতে আসিস না!

আরো মজা হচ্ছে, এদিকে আমাদের উচ্চারণ নিয়ে যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। যেমন প্রাইমারি স্কুলে পড়তে আমি কোথাও থেকে শিখে এসেছিলাম, 'ঠেলে' কে 'ঠিলে' উচ্চারণ করতে। মা বকে ঠিক করলেন। আর যেটা সহ্য করতে পারতেন না, 'স' এর তীক্ষ্ম শিস দেওয়ার মত উচ্চারণ, ইংরেজি বা হিন্দিতে 'S'-এর যে উচ্চারণটা হয়। বকা দিতেন।

কিন্তু এই যে আঞ্চলিক উচ্চারণের তারতম্যগুলো নিজের মধ্যে নিয়ে নিতেন, এর কারণ হিসাবে বলেছিলেন যাতে তার মনে না হয় মা অন্য ভাষায় কথা বলছেন।

একটা ঘটনা আমি আগেও লিখেছি, রামকৃষ্ণ মিশনের এক সময়ের শ্রদ্ধেয় প্রেসিডেন্ট স্বামী রঙ্গনাথানন্দজী একটা বন্ধঘর সভায় আলোচনা করছেন, ইংরাজি ভাষায়, হঠাৎ ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে বলতে শুরু করলেন। সবাই অবাক হল। তারপর খেয়াল করা গেল, যখন দেখা গেল যে চা ইত্যাদি দিতে এসেছিল সে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে মহারাজজীকে শোনার চেষ্টা করছে। তার আরো সহজে বোঝার জন্য উনি ভাষাটা হিন্দি করে নিয়েছিলেন।

গতকাল সন্ধ্যায় শ্রদ্ধেয়া যশোধরা রায়চৌধুরীর একটা বই প্রকাশনী সভায় আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম। সাধারণত আমার এমন সভায় যেতে কুণ্ঠা হয়। কাল গিয়েছিলাম, কারণ যশোদি। আর তাঁর কবিতা। অনেক জ্ঞানীগুণী মানুষ ছিলেন। আমি দেখছিলাম যশোদির অবাধ বিচরণ, আলাপের ক্ষমতা সবার সঙ্গে। সব কিছু নিয়ে কথা বলছেন, একজন জিজ্ঞাসা করলেন কোথা থেকে চুল কাটিয়েছেন, তাকেও যেমন উত্তর করলেন, তেমনই ভাষা আর কবিতার অভিব্যক্তির ধারা নিয়েও আলোচনায় কথা বলছেন। যেটা অবশ্যই তার নিজের বিচরণক্ষেত্র। সেটা খুবই স্বাভাবিক। খেয়াল রাখছেন সবাই চা পেলেন কিনা, সবাই বিস্কুট পেলেন কিনা। জিজ্ঞাসা করে নিচ্ছেন। যিনি বা যারা সাহায্য করছিলেন যশোদিকে, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা, ভালোবাসা সোচ্চারে জানাচ্ছিলেন।

যশোদি কবিতা নিয়ে আলোচনা করার যোগ্যতা আমার এখনও হয়নি। হবেও না। কারণ আমি কবিতার পাঠকমাত্র। সমালোচক নই। কবিতা হয় আমার কাছের ঘাসের শিশির, নয় দূরের নক্ষত্রের আলো। দুই-ই সত্য। যশোদির কবিতা ভীষণ কাছের। যা নিয়ে যশোদির পীড়া জন্মায়, সে পীড়াকে জানি। তাই যশোদির কবিতা ভাষার শুচিবাইতা মুক্ত, সেখানে সব শব্দেরা পাশাপাশি বসে যায়। মানে তৈরি করে। যে মানে একটা বোধে উত্তীর্ণ হয়। যে বোধটা আসলে একটা যন্ত্রণা। একটা পীড়া।

আরেকটু না বললেই নয়। জয়াদির কথা। জয়া কুণ্ডু-র সঙ্গে প্রথম দেখা হল ফেসবুকের বাইরে। কথা হয়েছে আগে একবার ফোনে। ওঁর স্প্যানিশ থেকে বাংলায় অনুবাদ পড়ে মুগ্ধ হয়েছি। কাল অত্যন্ত অল্পক্ষণ কথা হল। দেখলাম কি মুহূর্তের মধ্যে ভাবনাগুলো অত অল্প সময়ে স্পষ্ট করে বলে ফেলতে পারেন। আশা রইল আরো গল্পের।

গৌরী সেন। ফেসবুকে আলাপ ছিল। কিন্তু কথা হয়নি কোনোদিন। কিন্তু কে বলবে কথা হয়নি। সামনা সামনি হতে বুঝলাম আলাপ জমেছিল বহুদিন ধরে। কাল বুঝলাম। কিছু মানুষের ভালোবাসা কোনো এক মুহূর্তকে স্মরণীয় করে তোলে। কাল আপনি আমাকে সে মুহূর্তটা দিলেন। আমার সামান্য লেখালেখিকে এতটা ভালোবাসা দিয়ে। আর কি সুন্দর পড়েন আপনি, যশোদির কবিতাটা প্রাণে বিঁধল আপনার উচ্চারণে।

এবার ফেরার পালা। দৌড় দৌড়। শিয়ালদা থেকে ট্রেন গোলমাল শুরু হবে রাত গড়ালেই। ঘোষণা হয়ে আছে। ট্রেনে উঠলাম। মাথায় ঘুরছে অনেক ভাষার নাম। এসপেরান্ত, জার্মান, ফ্রেঞ্চ, বাংলা, ইংরাজি ইত্যাদি ইত্যাদি। ট্রেনভর্তি মানুষের চীৎকার, গল্প, গান। কেউ বিক্রি করছে, কেউ কিনছে, কেউ গল্প করছে, কেউ হেসে গড়িয়ে পড়ছে, কেউ গম্ভীর, কেউ বিষণ্ণ। সব যোগাযোগ হয়ে আছে ভাষায়। যে ভাষা গড়ায়। যে ভাষা চলে। ভাষা ভাষার বাঁধনে মানুষকে ছুঁয়ে যায়। ভাষা নিজেকে ভাষাতীত করে মানুষের মধ্যের গভীর মানুষের দিকে ইঙ্গিত দিয়ে যায়। সে ভাষার কোনো নাম নেই। সে ভাষা শুধু সামনে যে মানুষটা এসে দাঁড়িয়েছে তাকে ছোঁয়ার একটা মাধ্যম। আমার অহং যত পাতলা আমার ভাষা তত সত্য। একদিকে তার মানুষ আরেক দিকে তার অসীমকে না বাঁধতে পারার যন্ত্রণা। যে পীড়ায় জন্ম হয় কবিতার। দর্শনকে যুক্তিতে পেলে জন্মায় প্রবন্ধ। আর দর্শনকে যন্ত্রণায় পেলে জন্মায় কবিতা। দর্শনকে না পাওয়ার দর্শনও আরেক দর্শন। সেও আরেক কবিতা।

এ সবের পরেও হয় কিছু সম্পর্ক। যার সুতো ধরে থাকে নীরবতা। আর একটা ভাষা - আমি আছি। আমার সঙ্গে গিয়েছিল আমার কয়েকজন বন্ধু। বন্ধুর সঙ্গে যে ভাষায় কথা হয় পৃথিবীর কারোর সঙ্গে হওয়া সম্ভব নয়। এ তত্ত্বটা কৃষ্ণ ঠাকুর জানতেন। তাই গীতায় নিজেকে অর্জুনের বন্ধু বলে জানান দিলেন। উপনিষদও জানালো, তিনি বন্ধু। যদি তত্ত্ব খোঁজো তবে বিষাদ। যদি বন্ধু খোঁজো তবে সব সজীব। ভাষা হৃদয় থেকে আসুক প্রাণ ভরে।

সব শেষে একটা প্রশ্ন নিয়ে শেষ করি। আমরা কবিতা পাঠের মাঝে মাঝে হিন্দিভাষীদের মত 'ওয়াহ ওয়াহ' বলতে পারি না, আবার হাততালি দেওয়াটাও কেমন যেন শোনায়। তবে জানাব কি করে আমার ভালো লাগল? প্রাণে ছুঁলো? আমি কেমন করিয়া জানাব যশোদি আমার জুড়ালো হৃদয় জুড়ালো…..