Skip to main content

 

111.jpg

 

বৃষ্টি পড়ছে। ভূতের গল্প বলি। আমার ঠাকুর্দা নাকি ভূত দেখেছিলেন। আমার এক পাড়াতুতো মামা ছিলেন, তিনিও ভূত দেখেছিলেন। আমার এক বাংলার স্যার ছিলেন, তিনিও ভূত দেখেছিলেন। কত কত ভূতের গল্প। একদম প্রত্যক্ষ দেখা ভূতের গল্প। সে সব গল্পের স্বাদই আলাদা। আজকাল কেউ ভূত দেখে না। রাতদিন রিল দেখে। আরে ভাই অন্ধকারে ঘাড়টা তুললে তো সামনে একটা ভদ্রলোকের মত ভূত দেখবি।

মাঝে মাঝেই আমার ভূতেদের জন্য মন কেমন করে। তখন বাড়ির সামনের আলোটা নিভিয়ে চুপ করে বসে থাকি। কেউ এলেই তাকে চমকে দিয়ে একটু ভূত দেখার ঘোলের মত নকল স্বাদ পাওয়াই। কিন্তু একটা আস্তমস্ত ভূত দেখব সে সাধ আর পূরণ হওয়ার নয়।

ঠাকুর্দার গল্পটা কী আগে বলেছি? মনে পড়ছে না। তা ভূতের গল্পের যা আকাল পড়েছে এক গল্প দুবার বললেও অসুবিধা নেই। শুরু করি।

======= ========

ঠাকুর্রদা মাসে একবার করে গ্রামের বাড়ি যেতেন। তেমনই এক শনিবার গেছেন। সেদিন নাকি বিকেলে থেকে খুব বৃষ্টি। কিন্তু ঠাকুর্দা তো ঘরে থাকার মানুষ না। তিনি ঠাকুমাকে বললেন, যাই রমেশের বাড়ি তাস খেলে আসি গিয়ে। জেদি মানুষ। কেউ বারণ করার সাহস পেল না। তো ঠাকুর্দা দাদুর ছাতা বলতে যেমন ছাতা বুঝি, অনমনীয় কাষ্ঠল ছাতা, সেটা মাথায় করে, হাঁটু অবধি ধুতি তুলে বেরিয়ে গেলেন। আমি অবিশ্যি ঠাকুর্দাকে এই পোজে অনেকবার দেখেছি যখন হাওড়ায় থাকতাম। বৃষ্টি হলেই তো হাউড়িও গলিতে জল জমে যেত। ঠাকুর্দা ওরকম ধুতিটা হাঁটু অবধি তুলে, সেই ইয়াব্বড় ছাতা নিয়ে যাতায়াত করতেন। কোনোদিন ধুতি ছাড়া প্যান্ট পরতে দেখিনি ঠাকুর্দাকে।

তো ঠাকুর্দা যাচ্ছেন। ঘুটঘুটে অন্ধকার। বেশ খানিকটা রাস্তা। হঠাৎ দেখেন কালীমন্দিরের সামনের চাতালে কে একজন বসে আছে। ঠাকুর্দা গ্রামের সবাইকে চেনেন। এত রাতে কে এখানে? পুরুত ঠাকুর তো নয়, সে তো তার নিজের ভাই। সে তো ঘরেই দেখে এলেন। তবে? তিনি কাছে গিয়ে দেখেন তাঁর বন্ধুর ছেলে, নিমাই। তিনি বললেন, এই নিমাই….তুই এই বৃষ্টিতে এখানে বসে কেন? যা বাড়ি যা….ঝগড়া করে এসেছিস?

নিমাই কিছু বলল না। উঠে মন্দিরের পিছনে চলে গেল।

ঠাকুর্দা ভাবলেন, আজকালকার ছেলে…কে জানে কী চলছে মাথায়….যা হোক রমেশের বাড়ির থেকে তো ক'টা বাড়ি পরেই ওদের বাড়ি….গিয়ে বললেই হবে।

ঠাকুর্দা রমেশের বাড়ি গেলেন। রমেশ তাস গুছিয়ে বসেই ছিল। বলল, আমি তো ভাবছিলাম দাদা আজ কেউ আসবে না…..এসো….শুরু করি।

ঠাকুর্দা হাতে তাস নিয়ে বললেন, আজকালের ছেলেমেয়েদের কী মতি রে রমেশ….রাস্তায় আমাদের চুরাণের ছেলে নিমাইয়ের সঙ্গে দেখা হল….মন্দিরের চাতালে বসে….ডাকলাম….কোনো কথাই বলল না……

রমেশের গলার আওয়াজ না পেয়ে ঠাকুর্দা তাস থেকে মুখ তুলে তাকালেন। রমেশ বিস্ফারিত চোখে ঠাকুর্দার দিকে তাকিয়ে। ঘরে হ্যারিকেনের আলোয় রমেশের আলোছায়া মুখে কীসের যেন আতঙ্ক।

ঠাকুর্দা বললেন, নেশাটেশা ধরেছে না? মনে হয়েছিল….চুরানকে কী খবর দেবে?

রমেশ এতক্ষণে তাস গুটিয়ে ফেলেছে। বলল, দাদা চলো তোমার বাড়ি যাই….

ঠাকুর্দা হতভম্ব। মানে আমার বাড়ি কেন?

রমেশ কথা শুনল না। ইতিমধ্যে ছাতা হাতে রেডি। ঠাকুর্দাও অগত্যা উঠলেন। তারপর দুই বন্ধু বিনা বাক্যবায়ে বাড়ি এলেন। ঠাকুর্দা খেয়াল করলেন রমেশ ওই মন্দিরের রাস্তাটা এড়িয়ে এলো।

দরজার কাছে এসে রমেশ বলল, দাদা, নিমাই ওই মন্দিরের সামনের বটগাছে গেল শনিবার গলায় দড়ি দিয়েছে….আপনাকে ভালোবাসত…তাই দেখা দিয়ে গেল…..

ঠাকুর্দার নাকি এরপর ধুম জ্বর এসেছিল। এ গল্পটা আমি যতবার শুনতাম ঠাকুর্দার কাছে ততবার ওই কথাটা ভয় ছাপিয়েও মনটায় নাড়া দিত…..আপনাকে ভালোবাসত বলে একবার দেখা দিয়ে গেল….

========= ==========

এবারে বাংলার স্যারের গল্প বলি। এরকম একটা বৃষ্টির দিন। আমরা পড়তে গেছি। কিন্তু ফিরতে পারছি না। উনি শরদিন্দু, রবীন্দ্রনাথের ভূতের গল্প শোনাচ্ছেন। বেশ আমেজ তৈরি হচ্ছে। তখন ক্লাস টুয়েলভ। ভূত না মানি না বলার মধ্যে একটা বৌদ্ধিক গর্ব আছে। ভগবান মানি না বলার মত। কিন্তু আসলে ওই গর্বটা ছাড়া যে সত্যি আর কিছু নেই সেটাও সত্য। মুখে যাই বলি, ভিতরে ভিতরে তো দারুণ মজা পাচ্ছি।

গল্পটায় আসা যাক। বাংলার স্যার তখন কলেজে পড়েন। গ্রামে বাড়ি। কলকাতায় বেলঘরিয়ায় এক মেসে থাকেন। আরো চারজন বন্ধু সঙ্গে থাকেন, একই মেসে। বাড়িটা বেশ পুরোনো। তো হল কী, একবার বাড়িওয়ালারা সব পুরী বেড়াতে গেছে। দোতলাটা পুরো ফাঁকা। স্যারেরা একতলায় থাকেন। এবারে স্যারের ভার্সানে বলি।

আমরা অনেক রাত অবধি পড়াশোনা করে শুতে গেছি। শীত অল্প অল্প পড়তে শুরু করেছে। পাখা বন্ধ। ঘুমও এসে গেছে কখন। হঠাৎ দেখি গায়ে ধাক্কা দিচ্ছে পরিমল। আমি ধড়মড় করে উঠে বসেছি, ভাবলাম কারোর শরীর খারাপ হল হয় তো। কিন্তু ওর মুখটা দেখে কেমন সন্দেহ হল। আমাকে ইশারায় চুপ করে ছাদের দিকে আঙুল দেখাচ্ছে। আমি ছাদের দিকে তাকালাম। কী দেখব অন্ধকারে? কিন্তু এবার বুঝলাম। ওপরে ধুপ ধুপ আওয়াজ হচ্ছে। আবার দেওয়াল আঁচড়ালে যেমন শব্দ হয় তেমন শব্দ হচ্ছে ওপরের মেঝেতে।

দেখলাম সবাই জেগে গেছে। জগদীশ বলল, যাবি?

আমি বললাম, কিন্তু ওদের কাছে যদি অস্ত্র থাকে? আমাদের কাছে তো কিছুই নেই….

তবু ঠিক হল যাব। চুরিচামারি হলে আমাদের বদনাম। ঘরে যে বাটাম ছিল, সেটাই হাতে নিয়ে আমরা উঠতে শুরু করলাম। আশ্চর্য হল, দুটো ধাপ উঠতেই উপরের আওয়াজটা বন্ধ হয়ে গেল। আমরা পা টিপে টিপে উঠলাম। কী আশ্চর্য, দরজায় তো বাইরে থেকেই তালা দেওয়া! তবে? আর তো ঘরে ঢোকার রাস্তা নেই। তবে কী জানলা ভেঙে?.....

আমরা আবার নীচে নামলাম। টর্চ জ্বেলে পাতকুয়ো পাড়ের জানলাগুলো দেখলাম। বন্ধ। আবার রাস্তার দিকের জানলাগুলোও বন্ধ। তবে? আওয়াজটাও বন্ধ।

সারারাত জেগে কাটালাম। অনেক আলোচনা হল কী কী হতে পারে। কিন্তু একটা যুক্তিযুক্ত সমাধানে আসা গেল না।

পরেরদিন রাতে সবারই তাড়াতাড়ি ঘুম এসে গেছে। আগেরদিন সারারাত ঘুম হয়নি। কিন্তু হঠাৎ বিকট একটা আওয়াজে আমার ঘুম ভেঙে গেল। দেখি জগদীশ উঠে বসে আছে। বলল, দুবার হল। সিঁড়ি দিয়েও কেউ উঠল মনে হল। উঠবি? বললাম, থাক। সকালে দেখা যাবে।

সকালে দেখার কিছু ছিল না। সব ঠিক। দুদিন রাতও ঠিক কাটল। কিন্তু সব চাইতে চাপের রাত ছিল শেষ রাতটা। শেষ রাত বলছি কারণ ওইদিন ভোরেই ওদের পুরী থেকে ফেরার কথা।

আমরা ঘুমিয়েছি। হঠাৎ আমাদের ঘরের মধ্যে একটা আওয়াজ হল। বেশ জোরে। চারজনেই হুড়মুড় করে জেগে উঠেছি। আমার মাথার কাছে টর্চ থাকে। জ্বাললাম। দেখি মুড়ির কৌটোটা মাটিতে পড়ে, আর পচা বলে ডাকতাম যাকে, তার বইগুলো ওর টেবিল থেকে নীচে। ইতিমধ্যে জগদীশ আলো জ্বেলেছে ঘরের। দরজাটা বন্ধ। তবে?

হঠাৎ সিঁড়িতে ধুপধাপ আওয়াজ। কেউ যেন জোরে জোরে পা ফেলে উঠছে সিঁড়ি দিয়ে। আমাদের সবার চোখমুখ দেখার মত। এতদিন সবার মনে যে সন্দেহটা হচ্ছিল, কিন্তু সাহস বলার হচ্ছিল না সেটাই যেন স্পষ্ট চোখেমুখে এখন….

সকালে ওরা এসে পড়লেন। আমরা অপেক্ষাতেই ছিলাম। ভদ্রলোককে বললাম, দাদা আপনি ওদের উপরে পৌঁছে একবার আসবেন?

উনি এলেন। আমরা চেয়ারটা এগিয়ে দিলাম। যা ঘটেছে একে একে বললাম।

উনি চুপ করে সব শুনলেন। একটুও বিস্ময় নেই ওর চোখেমুখে। বরং একটা কষ্ট ফুটে উঠল। বললেন, আমার বাবা….পাগল হয়ে গিয়েছিলেন…..সামনে যে বাড়িটা….ওখানে আগে পুকুর ছিল একটা….ওখানেই ডুবে যান…..তোমরা মেস ছাড়তে চাইলে চলে যাও…..কিন্তু উনি কারোর ক্ষতি করেন না….এতটা বলতে পারি।

এ গল্পটা শেষ করার পর আমি স্যারের চোখ ভিজে দেখেছিলাম। উনি বললেন, আমাদের বাড়িওয়ালা ওর বাবাকে ভীষণ ভালোবাসতেন। আমরা মেস ছেড়ে দিয়েছিলাম। উনি শেষ মাসের টাকাটা নেননি। যাওয়ার আগে শুধু বলেছিলেন, আমি থাকলে যে বাবা কেন আসেন না….একবার মেরেছিলাম বলেই বোধায়….কেঁদে ফেলেছিলেন……

আমরা সবাই চুপ। স্যারও। বাইরে শরতের অকাল বর্ষণ। বৃষ্টির যে এত কথা বলার থাকে সেদিন বুঝেছিলাম।

========= ==========

আমার পাড়াতুতো মামার গল্পটা তেমন কিছু বড় না। মামাদের বাড়িতে ভাড়া থাকত একটা পরিবার। একটা বাচ্চা মেয়ে। আর তার বাবা মা। মামা তখন স্কুলে পড়ে। বাচ্চাটার মা কী একটা রোগে মারা যায়। বাচ্চাটা আর তার বাবা থাকে। মামা বলেন, ওই বাচ্চাটা আমাদের ঘরেই বেশিরভাগ সময় থাকত আমার মায়ের কাছে। ওর বাবা জুটমিলে কাজ করত। বেশ রাতে ফিরত।

মামা বলেন, একদিন অনেক রাতে আমি টয়লেটে যাব বলে উঠেছি, দেখি বাচ্চাটা বারান্দায়। আমি চমকে উঠেছি। কী করে বাইরে এলো?

আমি ওর কাছে গিয়ে বললাম, তুই বাইরে এলি কী করে?

ও একটু দূরে আঙুল দেখিয়ে বলল, মা….ওই যে….

আমার সারা শরীর ঠাণ্ডা হয়ে গেল। ওদের ঘরে গিয়ে দেখি, ওর বাবা অঘোরে ঘুমাচ্ছে। এত উঁচুতে ছিটকিনি ওর তো হাতে পাওয়া সম্ভব না। তবে?

ও কিছুতেই ঘরে যাবে না। এদিকে আমার বুকের মধ্যে হাতুড়ি পেটাচ্ছে। বাচ্চাটাকে জোর করে নিয়ে যাব? কিন্তু মন সায় দিল না ওই আতঙ্কের মধ্যেও।

আমার ঘরে এসে দরজা দিলাম। শুনলাম ওর হাসির শব্দ। বাচ্চাটার। অথচ সারাদিন ও এরকম হাসে না তো।

ক্রমে আমার অভ্যাস হয়ে গেল। ওরা বাড়ি করে অন্য জায়গায় চলে গেল। ওর বাবা আবার বিয়ে করল। আমার সঙ্গে মেয়েটার অনেকবার দেখা হয়েছে এরপরেও, কিন্তু আমি জিজ্ঞাসা করিনি কোনোদিন ওর মা আর আসেন কিনা। সঙ্কোচ হয়েছে। পরে জেনেছিলাম আমার মা সব জানতেন। আমি ভয় পাব বলে কিছু বলেননি। পরে মাকে দেখেছি গয়ায় দিদা দাদুর পিণ্ডির সঙ্গে ওই মহিলার নামেও পিণ্ডি দিয়েছেন। বলেছেন, শান্তি পাক।

এ গল্পগুলো একসাথে লিখতে লিখতে মনে হল, তবে কী আমরা ভালোবাসতে ভুলে যাচ্ছি বলেই ভূতেরা হারিয়ে যাচ্ছে? যারা যারা এসেছে, কেউ ভয় দেখাতে আসেনি। ভালোবাসার টানে এসেছে। ভয়ের কি টান হয়? টান তো ভালোবাসার। তাই কি হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের ভৌতিক ঐতিহ্য? মাটি পাথর কি আর ভূত হয়? মানু্‌ষই ভূত হয়। ভালোবাসে বলেই না ভূত হয়!

আমরা কি তবে মাটিপাথরের মত বস্তু হয়ে যাচ্ছি? ভালোবাসতে ভুলে যাচ্ছি? তাই কি ভূত হারিয়ে যাচ্ছে?