দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের বাইরে কচুরির দোকান। প্রচণ্ড ভিড়। শনিবার সকালবেলা। নিশীথের মনে যুদ্ধ জয়ের আনন্দ। বউ, মা, বাবা, শ্বশুর, শাশুড়ি, বোন, ভগ্নীপতি, নিজের দুই মেয়ে, বোনের এক ছেলে…সবাইকে নিয়ে এসেছে কৃষ্ণনগর থেকে। সেই কোন ভোরে বেরিয়েছে। অনেকেই খালি পেটে। পুজো দেওয়ার ব্যাপার ছিল তো!
পুজো দেওয়া শেষ। এখন সবাই কচুরি খাচ্ছে। সবার মুখ ঘেমে-নেয়ে একশা। রমার সিঁদুরটা থেবড়ে ঘেঁটে একশা। কি সুন্দর যে দেখতে রমাকে। যত দিন যাচ্ছে সুন্দর হচ্ছে। নিশীথবাবু জানে, রমাও জানে সে তাকাচ্ছে। এই পঞ্চান্ন বছর বয়সে ভালোবাসাটা উনুনের পাকা মাটির মত হয়ে যায়। একটা পোড়া পোড়া পাকা মাটির গন্ধ থাকে। ভরসা জোগানো গন্ধ।
======
লঞ্চ ছাড়ল। বেলুড়মঠে যাচ্ছে সবাই। সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে। যে যেমন বসার জায়গা পেয়েছে। সবারই চোখে ঘুম ঘুম ভাব। হবে না? যা সাতসকালে বেরিয়েছে সবাই।
রমা সামনের দিকে বসেছে। নিশীথ রমার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। রমা বলল, বসবে?
নিশীথ মাথা নাড়ল। রমা নিশীথের এই দৃষ্টিটা চেনে। রমা বলল, খেয়েছ ঠিকঠাক?
নিশীথ জানে এটা আসলে প্রশ্ন না। আলতো ছোঁয়া। মানে, আমি বুঝেছি, আমি আছি।
নিশীথ বলল, তুমি?
রমা জানে এ প্রতিপ্রশ্ন না, এ বাড়িয়ে দেওয়া হাতটা ছোঁয়া।
লঞ্চে লেবু চা বিক্রি হচ্ছে। অনেকেই কথা বলছে। রমা উদাস চোখে গঙ্গার দিকে তাকিয়ে। মাঝে মাঝে খুব গভীর থেকে সব কিছুর জন্যে কৃতজ্ঞতা জানাতে ইচ্ছা করে। কিন্তু কাকে কিভাবে জানাতে হয় বুঝতে পারে না। এই পুজোর ডালায়, এত মানুষের ভিড়ে, শুধু নামগোত্র দিয়ে কি কৃতজ্ঞতা জানতে পারে মা?
এই নাও…
লেবু চা এগিয়ে দিল নিশীথ।
রমা নিল। চুমুক দিল। নিশীথ নিজের কাপটায় চুমুক দিয়ে বলল, মিষ্টিটা কম হয়েছে না?
রমা বলল, কই…. না তো….
নিশীথ রমার কাপটা হাত থেকে নিয়ে বলল, তাই তো… আমারটায় কম মিষ্টি… লেবুটা বেশি চটকিয়েছে শালা….
রমা দুষ্টুমিটা বুঝল। কানটা গরম হয়েছে। কিন্তু কৃতজ্ঞতা জানাবে কাকে? মাথাটা পিছন দিকে কাত করে বাচ্চাদুটোকে দেখল, শাশুড়ির কোলে মাথা রেখে দুজনে ঘুমাচ্ছে, দুপাশ থেকে। শাশুড়ি মা-ও ঘুমাচ্ছে।
নিশীথ বলল, ফেরার সময় ব্যারাকপুর নামবে… বিরিয়ানি?....
রমা বলল, পাগল! অত টাকা নেই গো….আর আমার মা তোমার মা দু’জনেই খান না….
নিশীথ বলল, একদিনই তো…. বেরোনো তো হয় না বলো….
নিশীথের সাইকেল সারানোর দোকান। রমা সেলাই করে।
রমা বলল, হবে না বোধহয় আমার কাছে জানো….
নিশীথের মুখটা ছোটো হয়ে গেল। রমা "না" বলেছে মানে সত্যিই নেই।
রমা বলল, অন্য একদিন আসব না হয়….
নিশীথ বলল, আর অন্যদিন……
=====
ব্যারাকপুর ছাড়ছে ট্রেন। ভিড় আছে। মেয়েরা লেডিসে উঠেছে বাচ্চাগুলোকে নিয়ে। তারা জেনারেলে। আজ আর হল না, নিশীথের কান্না পেয়ে যাচ্ছে। এত কেন ছাড়তে হয়, এইটুকু তো চায় সে….
হোয়াটসঅ্যাপে আওয়াজ এলো। রমা লিখেছে, মন খারাপ কোরো না বাচ্চাদের মত…. আমরা একদিন আসব… প্রমিস…..
নিশীথ লিখল, দিলখুশ উঠেছে… কিনব?
হোয়াটস অ্যাপে ছবি এলো…. দু-প্যাকেট দিলখুশ… রমা কিনেছে। আর লিখেছে বসার জায়গা পেয়েছ?
রমা আবার ছুঁতে চাইছে। এত ভিড়, এত অ্যাডজাস্টমেন্ট ঠেলেও। কি অনায়াসে সরিয়ে দেয় সব।
নিশীথ লিখল…. শুয়ে আছি… আপার বার্থ…..
রমা লিখল….. টিটিকে দিয়ে আরএসি করিয়ে নিও…. একসঙ্গে যাব…. বসে….
নিশীথ হাসল। লিখতে চাইল অনেক কিছু…. কিন্তু মনটা অপরাধীর মত হয়ে গেল…. কিছুই দিতে পারে না পরিবারকে…. এটা আনতে সেটা ফুরায়….
রমা লিখল…. নেমে রুটি আর তড়কা কিনে নেব… আজ আর রাঁধতে ইচ্ছা করছে না…. ঠিক আছে?….
নিশীথ হাসির দুটো ইমোজি পাঠাল।
বাইরেটা পুরো অন্ধকার। মাঝে মাঝে বাড়ির আলোগুলো ছিটকে ছিটকে যাচ্ছে।….. তবু অনেক পেয়েছে। অনেক।
আবার অন্ করল হোয়াটস অ্যাপ, কিন্তু এই কথাটা লিখবে কি করে রমাকে? লজ্জা লাগে। তাছাড়া ভাষাও জানে না।
ফোন করল…. উত্তর এলো… মা ঘুমিয়ে পড়েছে বাবা…..
নিশীথ চুপ করে বসে। ভাষা খুঁজছে। রমাও ওদিকে ঘুমের মধ্যে তাকে খুঁজছে, যাকে কৃতজ্ঞতা জানাতে না পারলে বুকে অনেক ঋণ জমে যাচ্ছে। অনেক অনেক।
নিশীথ এতক্ষণে ভাষা পেল…. গুড নাইট…. আর প্রথমে তিনটে… তারপর দুটো…. তারপর একটা লাভ ইমোজি…. সেন্ড…. নীল দাগ… জাগলেই দেখবে। নিশীথ চোখ বন্ধ করে বসল। পায়রাডাঙার পর বসার জায়গা পেয়েছে। একটা সুখ কানে তালা লাগার মত পিঁইইইই করে বেজে যাচ্ছে। বাজুক।