চারটে বত্রিশের কল্যাণী লোকাল ছেড়ে যাচ্ছে কল্যাণী সীমান্ত স্টেশান। শীতের সন্ধ্যে বড় আদেখলা। বড় তাড়াতাড়ি আসে। না বলেই। বিনা ভূমিকায়। বিয়ে বাড়িতে গুরুত্বপূর্ণ আত্মীয় আসার আগেই যেমন ভিখারিরা চলে আসে। আড়ালে বসে থাকে। খেয়ালে পড়ে না।
সদ্য ঘুগনি বানিয়ে স্টেশানে এসে দাঁড়িয়েছে যে লোকটা, সে খানিক আগে বস্তির ঘরে শুয়ে শুয়ে পদাবলী কীর্তন শুনছিল। অজান্তেই। সে জানে না সে বাংলা সংস্কৃতির এক ধারক, বাহক। কোনো সম্মান, পদ না পেলেও।
স্টেশানের পাশে, রেললাইনের ধারে তাসের আড্ডা। লুঙ্গি, ধুতি পরে পুরুষেরা সময় কাটাচ্ছে খেলে।
"কি গো শুনছ?"
বিদ্যুতের খুঁটি, টোটোর গা, একটা ভাঙা গাছের গুঁড়িতে হাত দিয়ে দিয়ে ক্লান্ত এক মহিলা নাইটি গায়ে আসছে। ডাকতে ডাকতে। চোখে কাজল। বয়েস ছুঁয়েছে পঞ্চাশ।
"কি গো শুনছ?"
আর এগোতে পারল না। কারণ আর কোনো গুঁড়ি, কি কোনো বিদ্যুতের খুঁটি নেই। কি ধরে এগোবে? মুখ থেকে একটা শব্দ বেরোলো। অশ্লীল।
মহিলার পা দুটো অস্বাভাবিক ফোলা, রোগা শরীরে পেটটাও ফুলে আছে, যাচ্ছেতাই ভাবে। জল জমেছে শরীরে?
"কি গো শুনছ?"
একজন পাশের কালীমন্দিরে এসেছে একা। সংসারে হাজার একটা খুঁটি ধরে ধরে। মাকে প্রণাম করছে। "কি গো শুনছ?"
সন্ধ্যে নেমে গেছে। পাখির ঘরে ফেরার ডাক, স্টেশানের সব গাছগুলোয়। কয়েকটা কুকুরকে নিয়ে বসে আছে যে, মনে হচ্ছে পাগল। সব স্টেশানেই কি একজন পাগল থাকা বাধ্যতামূলক? যারা কোথায় যেতে হবে ভুলে গেছে, তারাই কি এসে বসে স্টেশানে?
মা মুড়ি আর চপ কিনছে বলে, মেয়েটা লাফিয়ে লাফিয়ে, ফ্রক আর ঝুলে যাওয়া সোয়েটারটা উড়িয়ে উড়িয়ে মশা মারছে। বলছে, "মর মর"।
যেন কতবার শোনা শব্দ আওড়াচ্ছে।
========
কল্যাণীতে বইমেলা চলছে। মনে ছিল না। কাজ শেষ। গেলেই হয়।
চল্লিশ টাকা টিকিট। বইয়ের জন্য নয়। আজ নচিকেতা আসবে। তাই। অন্যদিন কুড়ি টাকা।
শীত নেমে গেছে। বইমেলায় বড় অবহেলায় থাকে কবিতার বই। কোনো এক কোণে। চোখে, হাতে পড়ে না।
আমায় দেউলিয়া করে কবিতা। আমি এড়িয়ে চলি কবিতা। কিন্তু আমি চাইলাম না, না আমার হাত চাইল, তবু আমার চোখের সামনে দাঁড়িয়ে ভাস্কর চক্রবর্তী।
"যে বিকেলে জ্বর আসে
সেই বিকেলের মতো
তুমি এসে
দাঁড়িয়ে রয়েছো।"
নাকের কাছটা টাটিয়ে উঠেছে। কারোর চোখে যেন চোখ না পড়ে। কত ডিস্কাউন্ট হতে পারে বলছে বিক্রেতা। ভাস্কর চক্রবর্তীকে কত ডিস্কাউন্টে দেবে? পারবে না। কেউ পারেনি। কোনো শব্দ নিয়ে যে মানুষটার আজীবন কোনো ধোঁয়াশা ছিল না, যে মানুষটা সোজাসুজি তাকিয়ে, সোজাসুজি বিদ্ধ করে, সোজাসুজি চলে যায়, তাকে নিয়ে দরদাম করি কি করে? আমি কিনব না। আমি বিড়ম্বনায় পড়েছি বুঝছেন না কেন? কিছু শব্দ এখন আমায় ছিন্নভিন্ন করে যাবে, আমি শুধু ভাবব আমি সহ্য করব কি করে?
খাঁটি কবিতা অ-লোভ। বাকি সব লোভের কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়িয়ে। সব চাইতে লোভী ধর্মগ্রন্থরা, যারা নির্লোভের কথা বলে সব চাইতে বেশি। কবিতাই পারে নির্লোভত্বকে অতিক্রম করে অ-লোভ হয়ে যেতে।
গোটা বইমেলা হয়ে গেল ভাস্কর চক্রবর্তী।
"শিউরে উঠি, যখনই মনে পড়ে গত শীতের কথা।
এবারের শীতেও অবস্থা বেশ ঘোরালো
উফ, কী যাচ্ছেতাই সব দিনগুলো কাটাচ্ছি
দুলালের মা মারা গেল পরশুদিন
আমি কি ভুলে যাচ্ছি কীভাবে বেঁচে থাকতে হয়?"
সব বই মলাট বন্ধ করে আমার দিকে তাকিয়ে। খুব বেসুরো রবীন্দ্রসংগীত গাইছে কেউ। আমিও স্টলে স্টলে ফিরছি। অনর্থক। নিজেকে বাঁচাতে। আমার সঙ্গে সঙ্গে ফিরছেন নাছোড়বান্দা ভাস্কর চক্রবর্তী।
এই যে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের জন্মদিন গেলো। আমি একটা কথাও লিখেছি? আমি একবার আমার আশেপাশের একটা মানুষকেও জানতে দিয়েছি আমার মধ্যে কি তোলপাড় করে যাচ্ছে শক্তির কিছু শব্দ? আমি এমন একটা ফাঁকা স্টেশান খুঁজি আজীবন। নইলে কবিতাদের নিয়ে বাঁচা যায় না। পোড়া যায় না।
আমি আবার এসে বসে আছি স্টেশানে। কিছু মানুষ এদিক ওদিক ছড়িয়ে। কেউ কারোর সঙ্গে কথা বলছে না। অনেক রাতে মানুষ নিজের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাকে অনুভব করে। একাকীত্ব বেহালার সুরের মত বেজে চলে। এই তো নিজেকে প্রশ্রয় দেওয়ার সময়। যে কথাগুলো মনে থাকে বাকি সব কাজের কথাদের সাক্ষী হয়ে, স্টেশানের পাগলটার মত, সে কথা বলতে শুরু করে এই সময়।
"গাছ আর
গাছের ছায়ার নিচে দড়ির খাটিয়া
আমাদের তৃতীয় পৃথিবী"
আমি একা বসে আছি। আমার সব ভাষায় জড়ো করে দাঁড়িয়ে আছে, ভাস্কর চক্রবর্তী।